রবিবাসরীয় গল্প
দু’নম্বরের ডিফারেন্স
বে লোডশেডিং কেটেছে। সন্ধে সাতটা। বুবাই ইমার্জেন্সি লাইট নিভিয়ে ঘাড় নিচু করে অঙ্ক করছে। কাল ওর ম্যাথস পরীক্ষা। নৃপেন এখনও অফিস থেকে ফেরেনি। ফেরার সময় হয়ে এল। মীরা বলল, একমনে অঙ্ক করে যাও, আধ ঘণ্টা পরে এসে আমি কমপ্ল্যান দেব... একতলা থেকে আসছি।
বুবাই জানে তার কনসেনট্রেশন যাতে নষ্ট না হয়, সে জন্যই মা একতলায় মিমিকাকিমার ফ্ল্যাটে যাচ্ছে টিভি দেখতে। এই সময় কী নাকি একটা সিরিয়াল হয় মা ওটা না দেখে থাকতে পারে না। মিমিকাকিমার তো ছেলেমেয়ে নেই, ওদের ঘরে টিভির কোনও রেসট্রিকশন নেই।
তিন তলায় নৃপেনের ফ্ল্যাট। প্রথমে কোলাপসিবল গেট। তার পর দরজা। ছোট্ট আই-হোল। সামনে যে তিন ফুটের স্পেস সেখানে শখ করে তিনটে টব রেখেছিল নৃপেন। বেলি ফুলের ঝাড়। ফুলসমেত একশো কুড়ি টাকায় কিনে এনেছিল বকুলতলা বাজার থেকে।
দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে মীরার নজর প্রথমেই আটকে গেল টবের গায়ে, পরিত্রাহী চিৎকার করে উঠল, সাপ... সাপ... সাপ... দু’পা এক লাফে পেছিয়ে এল।
মীরার ওই চিৎকারে মুখোমুখি ফ্ল্যাটের দরজা খুলে ঋজুর বাবা দেবদাস বলল, কোথায়? কোথায়?
ভয়ে সাদা মুখে মীরা আঙুল তুলে টব তিনটে দেখাল। এ বারে দেবদাস দেখতে পেল। ছাই আর হলদে চকরি কাটা বড় একটা খোলস। সে চৌকাঠের ভেতরে দাঁড়িয়ে বলল বউদি, খোলস যখন ছেড়েছে সাপটা ওই বেলি ফুলের ঝাড়ের মধ্যেই লুকিয়ে আছে।
মীরা ভীত-সন্ত্রস্ত চোখে এ দিক ও দিক তাকাল। ইস্, এখনও কেন যে নৃপেন ফিরছে না। ভীষণ রাগ হচ্ছিল স্বামীর ওপর।
দেবদাস ফের বলল, খোলস ছাড়ার পর সাপেরা খুব রেগে থাকে কিন্তু... খোলসটা দেখে মনে হচ্ছে খুব বিষাক্ত সাপ...
কথা শেষ করেই দেবদাস দরজা বন্ধ করল। মীরা অবাক হয়ে দেখল দরজার তলায় যে সামান্য ফাঁকটুকু, যার মধ্যে দিয়ে ঘরের আলো দৃশ্যমান হয়, সেখানে ঠেলে ঠেলে ন্যাকড়া গুঁজে দিচ্ছে ঋজুর বাবা।
দেবদাসের পাশে দ্বিজেন ঘোষালের বউ দরজা তিন ইঞ্চি ফাঁক করে শুধোল, কী সাপ মীরাদি? কোবরা?
যেন কোবরা হলে ও খুশি হয়। মীরা রাগে জবাব দিল না। মীরার চিৎকারটা নিশ্চয়ই জোরে ছিল। নইলে নীচের তলার দিব্যেন্দুর মা বকুল, যে দুপুরের অবসরে মীরার সঙ্গী, সে নীচের সিঁড়ির তলা থেকে কোনও রকমে গলা তুলে, ‘দিদি সাবধান, ওয়াচ করুন নীচে নামছে কিনা সাপটা’ বলেই একেবারে বোবা হয়ে যায়!
বুবাই অঙ্ক ছেড়ে খাটের ওপর পা তুলে। ভয়ে জবুথবু। মীরা ছেলেকে দ্রুত একনজর দেখেই বলল, খবরদার, খাট থেকে নেমো না কিন্তু...
তখনই নৃপেন ফিরল।
তিন তলায় ওঠা মাত্র মীরা বলল, দাঁড়াও, আর এগিয়ো না। সাপ...
সাপ?
হ্যাঁ, টবের গায়ে খোলস ছেড়েছে...
এখানে সাপ? তিন তলায়?
মীরা ঝেঁঝে উঠল, তর্ক করার অভ্যেসটা আজও গেল না। যাও, তুমি খুব তাড়াতাড়ি একটা ফিনাইল আর এক বোতল কার্বলিক অ্যাসিড কিনে নিয়ে এসো। তাড়াতাড়ি...
যত দ্রুত নির্দেশ দিল মীরা তার চেয়ে দ্রুত নামতে লাগল নৃপেন। ফিরেও এল দ্রুত। সামনেই দোকান। মীরা তীক্ষ্ণ নজরে বেলি ফুলের ঝাড়টা লক্ষ করছিল। সাপ বড় হলেও দ্রুত নিজেকে গুটিয়ে ছোট্ট করে রাখতে পারে বিপদ বুঝলে।
মীরা বিড়বিড় করে উঠল, লোডশেডিংয়ের সময় মনে হয় সাপটা কোনও ভাবে উঠে পড়েছে...।
বুবাই চেঁচিয়ে বলল, মা খুব টয়লেট পেয়েছে...
মীরা ধমকে উঠল, কিছুক্ষণ চেপে রাখো। তোমার বাপি কার্বলিক অ্যাসিড আর ফিনাইল দিয়ে বাথরুম আর টয়লেট দুটোই ভাল করে ধোয়াবে। তার পর যেয়ো...।
বুবাই মুখ কুঁচকে বলল, খুব প্রেশার মা...
আঃ, ইমার্জেন্সিতে সব সহ্য করতে হয়...
তখনই মীরার মোবাইল বেজে উঠল। একতলার ছন্দা মোবাইলে সাপের খবর নিচ্ছে কী সাপ রে? হিসহিস করছে? শোন, মাথা ঠান্ডা রাখ, আর একটা কথা বলি সাপ কিন্তু কম্পন টের পায়, বেশি দৌড়োদৌড়ি করিস না...
মীরা কড়া স্বরে বলল, উপদেশের জন্য ধন্যবাদ। মনে মনে বলল, স্বার্থপর।
ততক্ষণে টবগুলোর আশেপাশে কার্বলিক অ্যাসিড আর ফিনাইল ছড়িয়ে দিয়েছে নৃপেন ভাল করে।
মীরা বলল, যাও এ বারে বাথরুম আর টয়লেটে বেশ করে ছড়িয়ে দাও... যদি সাপটা কোথাও লুকিয়ে থাকে ঠিক বেরিয়ে যাবে...
নৃপেন ধস্ত স্বরে বলল, কোথায় যাবে?
মীরা রেগে গেল তা জেনে আমাদের লাভ? রাহুলের ঘরে যেতে পারে, ছন্দার ঘরে যেতে পারে, ঋজুদের ঘরে যেতে পারে, ষোলোটা ফ্যামিলি আছে, যার ঘরে যাক আমাদের কী! শুধু আমাদের নিশ্চিন্ত করুক... ব্যস...।
বাথরুম, টয়লেট, খাটের তলা এবং সামনের টব ও সন্নিহিত জায়গা কার্বলিক অ্যাসিড আর ফিনাইলের বোতল শেষ করে ফেলল নৃপেন। তার পর ক্লান্ত সে কপালের ঘাম মুছে বলল, ওহ... অফিস থেকে ফিরে একটু বিশ্রাম পেলাম না। তার পরই কিছু একটা চিন্তা করে নৃপেন ফের বলল, সাপ থাকলে নিশ্চয়ই বেরিয়ে যেত, তা ছাড়া তিন তলায় সাপ ঢুকবে কী করে? মনে হয় কেউ শয়তানি করেছে...
তা খোলসটা কি আকাশ থেকে এল?
তা কেন? ওটা ঠিক আছে। রাস্তাঘাটে বা ঝোপঝাড়ে কেউ হয়তো ওটা পেয়ে শয়তানি করে আমাদের টবের গায়ে রেখে দিয়ে গিয়েছে...
মীরা ভুরু কোঁচকায়। তার মনে পড়ে যায় একটু আগে পাক্কা এক ঘণ্টা লোডশেডিং ছিল।
কেউ তো শয়তানিও করতে পারে। নিশ্চুপ মীরা ‘শয়তানি’ শব্দটা আঁকড়ে ধরে সমুদায় দুশ্চিন্তা কাটাতে প্রয়াসী হল, মৃদু স্বরে বলল হুঁ, সেটাও হতে পারে...
নাও এ বারে চা করো, মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে...
আচ্ছা, তোমার কি মনে হয় বলো তো, কে শয়তানি করতে পারে?
নৃপেন হাসল ওহ বোঝো না কেন? ‘শয়তান’ শব্দটা যতটা খারাপ ‘শয়তানি’ শব্দটায় ততটা খারাপ নেই। আজকাল ওটা এক জাতের মজা। ফান। এমন যে কেউ করতে পারে। বা এমনও হতে পারে কেউ আমাদের মনে একটা মিথ্যে টেনশন পুঁতে দিতে চায়...
মিথ্যে টেনশন?
হ্যাঁ, যে কোনও রোগের চেয়েও এটা ভয়ংকর। এক বার ঢুকিয়ে দিতে পারলেই কেল্লা ফতে।
চা বানাতে বানাতে মীরা দ্বিতীয় সম্ভাবনাটার কথাটাই ভাবছিল। কে? কে হতে পারে? তখনই তার আমচকা মনে পড়ে গেল চার তলার সৌরদীপের কথা। বুবাইয়ের সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ে। প্রতি বছর বুবাই ফার্স্ট হয়। সৌরদীপ সেকেন্ড। এই নিয়ে সৌরর মা তমালিকার হিংসের শেষ নেই। হতে পারে তমালিকার পরামর্শে ওর স্বামী সাপের খোলসটা বাইরে থেকে এনে ওদের টবের গায়ে ফেলে রেখেছে। অন্তত এই টেনশনে বুবাইয়ের ম্যাথস পরীক্ষার প্রস্তুতি যেন হোঁচট খায়।
তখনই বাবাই বলল, মা এ বারে যাই টয়লেটে?
মীরা ঘাড় নাড়ল, যাও...
আমার ভয় করছে মা...
নৃপেন বলল, কীসের ভয়...
পা টিপেটিপে যে ভাবে টয়লেটে ঢুকেছিল ঠিক সে ভাবেই বেরিয়ে এল বুবাই। মীরা মা বলে কথা। সর্বত্র কড়া নজর। দ্রুত উঠে এল, জিজ্ঞাসা করল, ক্লিয়ার হল?
ঘাড় নাড়ল বুবাই, মুখে উৎকণ্ঠার চিহ্ন অত টেনশন নিয়ে কি ইয়ে ক্লিয়ার হয়? পা ঝুলিয়ে কমোডে বসতেই তো ভয় হচ্ছে...
মীরা এ বারে রেগে বলল, তোমার ভয়টা আবার বেশি বেশি... ঘরে আমরা আছি না! হুঁঃ টেনশন! নিজের চোখে দেখলে বাপি গোটা ঘর বারান্দায় কার্বলিক অ্যাসিড আর ফিনাইল ছড়িয়েছে, তন্নতন্ন করে খুঁজেছে, তবু ভয়! ঠিক আছে, এক দিন ইয়ে না হলে কিছু যায় আসে না। অনেক সময় নষ্ট হল। এ বারে অঙ্কে ডুবে যাও...
আমি খাটেই বসি মা...
না খাটে পড়া হয় না। একটু পড়েই শুয়ে পড়বে। তার পরই ঘুম। খাট দেখলে সবারই ঘুম পায়। তুমি চেয়ারেই বসো।
আমার যে এখনও ভয় করছে মা...
মীরা চিৎকার করে উঠল, বোগাস! কীসের ভয়? কেউ খোলসটা ফেলে দিয়ে শয়তানি করেছে। তুমি অঙ্ক শুরু করো। আমি খাটে বসে চার দিকে ওয়াচ রাখছি...
সাপের দুশ্চিন্তা কেটে গিয়ে মীরার মাথায় এখন অন্য দুশ্চিন্তা।
ঘণ্টাখানেক পরে মীরা ব্যালকনিতে নৃপেনের সামনে এসে চেয়ারে বসল শোনো, একটা পাল্টা টেনশন ঢুকিয়ে দিতে হবে তমালিকা আর সৌরদীপের মনে...
নৃপেন অবাক তাতে কী লাভ?
আঃ তুমি কিচ্ছু বোঝো না। এটাও একটা পলিটিকস। ওদের মনের মধ্যে, বিশেষত সৌরদীপের মনের মধ্যে যদি কোনও একটা ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া যায়, তা হলে ওরও ম্যাথস পরীক্ষাটা খারাপ হবে। তাতে আমার বুবাইয়ের সঙ্গে ওর ডিফারেন্সটা থেকে যাবে। বা হয়তো সৌরদীপ আরও নেমে যেতে পারে। আমি বুবাইয়ের ফার্স্ট না হওয়াটা কিছুতেই সহ্য করতে পারব না। বছর বছর যে ফার্স্ট হয়ে আসছে তার এবং তার পরিবারের মানসিকতায় প্রথম স্থান ছাড়া অন্য কিছু থাকে না। সেকেন্ড বা থার্ড এগুলো কোনও স্থান নয়, সব পরাজয়।
নৃপেন বলল, তা আমাকে কী করতে হবে?
মীর ঘনিষ্ঠ হয়ে বলল, সেটাও ভেবে রেখেছি। তুমি বাইরের কোনও বুথ থেকে সৌরদীপের বাবার মোবাইলে ফোন করে বলো যে কাল সকাল দশটার মধ্যে নগদ দশ লক্ষ টাকা না দিলে সৌরদীপকে কিডন্যাপ করা হবে। ব্যস, এটুকুই। তার পরই ফোন কেটে দাও। তাতেই কাজ হয়ে যাবে... টেনশনে কেউ ঘুমোতে পারবে না...
নৃপেন গম্ভীর স্বরে বলল, তুমি আমায় জেল খাটাতে চাও! ওর বাবা পুলিশে খবর দেবে না বুঝি! পুলিশ ঠিক ট্র্যাক করে বার করে ফেলবে কোন বুথ থেকে ফোন হয়েছিল। এ ভাবে পুলিশ কত সাংঘাতিক অপরাধের কিনারা করে ফেলছে। ছিঃ, তখন যদি সত্যিটা বেরিয়ে পড়ে আমরা মুখ লুকোতে পারব? ধারকাছের সব বুথেই আমাকে চেনে। এটা একদম কাঁচা কাজ।
মীরা চুপ করে গেল। সম্ভবত অন্য কোনও পাকা কাজের কথা ভাবছিল। কিন্তু মনে পড়ছিল না।
রাতে মীরাকে জড়িয়ে অনেক আদর করল নৃপেন, তার পর কানের লতিতে সুড়সুড়ি দিয়ে বলল, এসো...
মীরার স্বরে কোনও উত্তেজনা নেই। নৃপেন মৃদু টানল। মীরা একটু সরে গেল। তার পর চাদরে সর্বাঙ্গ ঢেকে শীতল স্বরে বলল, দু’নম্বরের ডিফারেন্স, ভুলতে পারছি না।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.