|
|
|
|
|
|
|
কুমোরটুলির অতিথি |
ক্লাসরুম, টেবিল, চেয়ার, লেকচার-হল কিছুই নেই, অথচ পাকা পাকা কারিগর
বেরিয়ে আসছে পুরুষানুক্রমে।
খেলতে খেলতে শিল্পী হয়ে উঠছে যেন মন্ত্রবলে।
প্রতিমা বানানোর সাজঘর দেখে এলেন জয়ন্ত দাস |
শরৎচন্দ্রের পণ্ডিতমশাইয়ের মতো জলচৌকিতে বসে আছেন রাখাল পাল। পরনে ধুতি, ঢাকাইয়া কায়দায়। গায়ে সুতির ফতুয়া। পণ্ডিতমশাইই বটে, তাঁকে ঘিরে একঘর কারিগর। কেউ কাঠামোতে খুটুরখুটুর করছে, কেউ খড়ের আঁটি পাট করছে, কেউ আবার মুখের মাটি ছেনে চলেছে এক মনে। রাখালবাবুর কোলের উপর তবলার বিড়া, শাড়ির পাড়ে বাঁধানো। তার উপর প্লাস্টার অব প্যারিসের মুখের ছাঁচ। গভীর মনোনিবেশ মুখ রচনায়। অথচ সারা ঘরে কারিগররা কে কী করছে, সে দিকেও সজাগ লক্ষ্য। নইলে ঢাকার কথ্য ভাষায় অমন হুঙ্কার শোনা যেত না, ‘ওইডা কী হইতাছে, ব্যানা, না খড়ের মণ্ড? মাটি পড়লে সিংহ তো অসুররে গিলব না, গিল্লা খাইব রাখাল পালেরে। বাসুদেব, ও বাসুদেব, ব্যানা খুইল্লা নতুন কইর্যা বাঁধ।’ বাসুদেব নতুন করে বাঁধতে বসলেন। ও দিকে রাখালবাবু তখনও বিড়বিড় করছেন, ‘এ তোমাগো নদিয়ার সিংহ নয়, যে মাটি না চাপাইলে রা করে না। বিক্রমপুরের সিংহ খড় বাঁধলেই তর্জন করে। ধ্যান দাও, ধ্যান দাও!’
নব কলেবরে যখন বিক্রমপুরের সিংহ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে তখনই দেখা গেল ছাঁচ থেকে বেরোনো প্রতিমার পানপাতা মুখ। রাখালবাবুর কোলে। তিনি এই মুখকে বলেন ‘মান্ষেরা’। মুখের দিকে খানিক ভ্রু-কুঁচকে চেয়ে সেই জয়দেবকেই ডাকলেন, ‘দ্যাখ তো, গড়নটা তেরা-ব্যাকা হইল নাকি, তগো জ্বালায় চোখটা তো... ব্যাকা হইলে ছাঁচে ফেইল্যা ঠিক কর।’ অতগুলো কারিগরের সামনে সিংহ বাঁধার ভুলে অপমানিত কিশোর ফিরে পেলেন আত্মবিশ্বাস। ফিরে এল কাজের ছন্দ।
প্রায় দু’দশক আগে দেখা এই ছবি বুঝিয়ে দিয়েছিল, এই কুমোরটুলিই শিল্প চর্চার পাঠশালা। ওবিন ঠাকুর কী সাধে বলেছিলেন, ‘‘এই শহরের মধ্যেই এখনও তেমন সব পাড়া খুঁজলে পাওয়া যায় কাঁসারিপাড়া, পোটোতলা, কুমোরটুলি, বাক্সপটি ইত্যাদি। এই সব জায়গায় শিল্পী কারিগর দু’রকমের লোক আছে, যারা ওস্তাদ এক-এক বিষয়ে। ওস্তাদরা ঘরে বসে কাজ করছে, চেলারা যাচ্ছে সেখানে কাজ শিখতে ওই সব পাড়ার ছোট-বড় নানা ছেলে! সেখানে ক্লাসরুম, টেবিল, চেয়ার, লাইব্রেরি, লেকচার-হল কিছুই নেই, অথচ দেখা যায় সেখান থেকে পাকা পাকা কারিগর বেরিয়ে আসছে পুরুষানুক্রমে আজ পর্যন্ত। খেলতে খেলতে artist, artisan কারিগর শিল্পী হয়ে উঠছে যেন মন্ত্রবলে।’’
|
দিন ঘনিয়ে এল |
‘ক্রমে দুর্গোৎসবের দিন সংক্ষেপ হোয়ে পড়্লো;’ কার্তিকের ৩ তারিখ যদি ষষ্ঠী হয়, হুতোমের টিপ্পনীতে তা তো ‘সংক্ষেপ’ বটেই! মাঝে আর ক’টাই বা দিন! সে কালে এই মরসুমেই ‘কৃষ্ণনগরের কারিকরেরা কুমারটুলী ও সিদ্ধেশ্বরীতলা জুড়ে বসে’ যেত। দেখা মিলত ‘জায়গায় জায়গায় রং করা পাটের চুল, তবলকীর মালা, টীন ও পেতলের অসুরের ঢাল তলওয়ার, নানা রঙ্গের ছোবান প্রিতিমের কাপড়’। সে কালের প্রবচন ছিল-- রথের রশিতে টান পড়লে কুমোরটুলি আড়মোড়া ভাঙে, আর জন্মাষ্টমী ছুঁলে সাজো সজো। অথচ সে দিনের ব্যস্ততা তেমন করে নজরে পড়ল না তো!
কোথায় গেলেন রাখাল পালের বাসুদেব, অবনীন্দ্রনাথের ‘ওস্তাদের ঘরের চেলারা’ বা হুতোমের ‘কৃষ্ণনগরের কারিকরেরা’?
উত্তর মিলল ধুবুলিয়ার প্রবীণ কারিগর মাস্টারদার কাছে। সাড়ে চার দশক ধরে এ পাড়ায় আনাগোনা তার। ‘দেশ-গাঁয়ে এখন জোরকদমে চাষের কাজ চলছে। বৃষ্টি হোক বা না হোক, যারা কুমোরটুলিতে কারিগর হয়ে আসবে, তাদের দু’হাতই এখন আটকা। বিশ্বকর্মা পুজো পেরোলেই এ পাড়ায় এসে দেখবেন, পা ফেলার স্থান পাবেন না।’ |
|
ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী |
কুমোরটুলির অন্দরমহলে আদ্যিকাল থেকে দু’টি ভাগ স্পষ্ট। ধনঞ্জয় রুদ্র পাল বলতেন, ‘ও দিকটা হিন্দুস্থান, আর এ দিকরে কয় পাকিস্তান।’ আদিম পূর্ব-পাকিস্তান। তুলনামূলক ভাবে অনেকটাই এগিয়ে আছে পাকিস্তান। অন্তত গোরাচাঁদ পাল, শ্রীকৃষ্ণ পাল বা মোহনবাঁশি রুদ্র পালদের ঘর মূর্তিতে ঠাসা। দোমেটের কাজও শেষ। সর্বজনীন কর্তাদের আনাগোনা, এমনকী বায়না নামাও চলছে। অনেক প্রতিমার হাতেই ঝুলছে হলুদ পোস্টকার্ড। তাতে পাড়ার নাম, পুজো সভাপতির নাম, প্রতিমা কী রঙের শাড়ি পরবে, গায়ের রং হলুদ, না কমলা, নাকি পদ্ম-আভা গোলাপি হবে তার বর্ণনা। দু’টি ফাইবারের প্রতিমা তো সম্পূর্ণ প্রস্তুত। গোরাচাঁদবাবুর পুত্র গোপাল পাল বললেন, ‘একটি যাচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকায়, অন্যটি আমেরিকায়।’
ও দিকে ‘হিন্দুস্থান’-এ এখনও চলছে কাঠামো গড়ার কাজ। জনা ছয়েক কারিগর নিয়ে তারই তদারকি চলছে মহিলা কুমোর চায়না পালের চালা ঘরে। তিনি নিজে একটা বাঁশের চৌকির উপর বসে, অনেকটা ‘ধন্যি মেয়ে’ জয়া ভাদুড়ীর গাছের ডালে পা ঝুলিয়ে পেয়ারা খাওয়ার কায়দায়। পা-ও দুলছে আর কারিগরদের বকুনি দিচ্ছেন, ‘সাত পুয়া দুর্গার চালি হবে, দু’পাশে পাঁচ পুয়া করে সাইড পুতুল, কাঠামো ছোট হয়ে যাচ্ছে না?’ সাত পুয়া দুর্গা মানে? ‘পুয়া মানে মুঠি। এক মুঠি, এক পুয়া। আবার পাঁচ পুয়ায় এক হাত। মানে দুর্গার মাপ দেড় হাতের কাছাকাছি।’ বোঝালেন চায়না। আর সাইড পুতুল? ‘ওই দু’পাশে লক্ষ্মী-গণেশ, কার্তিক আর সরস্বতী...।’ নদিয়া-নবদ্বীপ-শান্তিপুরের কারিগররা অতঃপর কাঠামো মেরামতিতে মন দিলেন। ‘ধন্যি মেয়ে’র পা দুলতেই লাগল।
|
কালবেলার উপাখ্যান |
ফিরে আসি মাস্টারদার গল্পে। এই মুহূর্তে কুমোরটুলির বোধ হয় সবচেয়ে অভিজ্ঞ কারিগর। তিনি অবশ্য বলেন, ‘আমার চেয়েও দক্ষ কারিগর অলক সেনের ঘরের কার্তিক পাল, কেনা পালের ঘরের বিভূতি সামন্ত, আর গোরাচাঁদ পালের ঘরে খোকন অধিকারী।’ নাম ‘মাস্টারদা’ কেন? সূর্য সেনের মতো বিপ্লব-টিপ্লব...। ‘আরে না না, আমি মাস্টারিই করতাম ধুবুলিয়ার প্রাথমিক স্কুলে। নকশাল আমলে হঠাৎ পুলিশ ধরল। কেস দিল নকশাল হিসেবে। জেল খাটলাম। তার পর ছাড়া পেয়ে এক আত্মীয়র সঙ্গে পাকেচক্রে কুমোরটুলিতে। এর ঘর ওর ঘরে বছর কয়েক ঠিকে কাজ করার পর রাখাল পালের ঘরে জায়গা হল। সেই থেকে একটানা রাখালবাবুর সহচর। রাখালবাবু চোখ বুজেছেন, আমরা তাঁর কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।’ তা হলে আসল নাম? ‘যতীন পাল’। একেই বলে কাকতালীয়, সূর্য সেন না থাক। বাঘাযতীন তো আছেন!
মাস্টারদার গল্প শুনতে শুনতে মেলাচ্ছিলাম আর এক কারিগর রাজকুমার পালের কুমোরটুলিতে আসার বৃত্তান্ত। জন্মভূমি নদিয়ার পাগলাচণ্ডী। কিন্তু ছাত্রজীবন কাটছিল বর্ধমানে, নির্বিঘ্নেই। লেখাপড়া শিখে চাকরিবাকরির তালে ছিলেন। প্রি-ইউনিভার্সিটির রেজাল্ট বেরোতে না বেরোতেই পুলিশ হাতকড়া পরাল। তাঁর গায়েও নকশালের আঁশটে গন্ধ পেয়েছে পুলিশ। জেল খাটলেন, জরিমানা দিলেন এবং বর্ধমান ছাড়লেন। এসে উঠলেন কুমোরটুলিতে। কার্তিক পালের ঘরে, উঠেছিলেন ’৭৮-এ। দেখতে দেখতে চৌত্রিশ বছর কেটে যাচ্ছে। এই জন্যই কি নকশাল আমলের উত্তাল সময়ে পুলিশের চোখে কুমোরটুলি একটা ঘাঁটি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল? রাজকুমার অতশত জানেন না, কিন্তু মাস্টারদা বলেন, ‘ঘাঁটি না হলেও নদিয়া থেকে নকশালরা তাড়া খেয়ে প্রায়ই কারিগর সেজে কুমোরটুলিতে এসে গা ঢাকা দিতেন। পুলিশ সেটা বুঝেছে অনেক পরে। আর বুঝতে পেরেই তাঁরা ধরেছে রতন চক্রবর্তীর মতো নিরীহ এক কারিগরকে।
পুরোহিত আদিনাথ চক্রবর্তীর ছেলে রতন থাকতেন উড়ে পাড়ায়। ছেলেবেলায় মা-হারা ছেলে। আদিনাথ চেষ্টা করেছিলেন লেখাপড়া শেখাতে। কিন্তু বামুনের ছেলে স্বপ্ন দেখে প্রতিমাশিল্পী হওয়ার। তখন রাধানাথ পাল, কেষ্ট পাল, মনু পাল, মাখনচন্দ্র পালদের রাজত্ব। রতনের কিন্তু মন-প্রাণ বসে গেল গোরাচাঁদ পালের প্রতিমায়। আদিনাথ কী করেন! শেষে গোরাচাঁদবাবুর হাতেই সঁপে দিলেন রতনকে। কারিগর হতে শুরু করলেন রতন। কাঠামো বাঁধা থেকে খড়ের বাঁধুনি, এক মেটে দো মেটে, ছাঁচ তোলা...। কিন্তু চক্রবর্তী পদবিটা হয়ে উঠল বিপদের কারণ। পুলিশের বিবেচনায় যে পাড়ায় ঘরে ঘরে পাল-সাম্রাজ্য। সেখানে চক্রবর্তী এল কোথা হতে? ’৭১-এর এক অপরাহ্নে শ্যামপুকুর থেকে পুলিশ এসে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে গেল রতনকে। জেল থেকে ছাড়া পেলেন সপ্তাহখানেক পরে। এর পর গোরাচাঁদবাবুই হাতে কিছু টাকা দিয়ে তাঁকে পাঠিয়ে দেন রাঁচিতে। ছোট একটি চাকরিতে। রতনের জীবন উপাখ্যান বদলেই যাচ্ছিল। কিন্তু ‘মনে যদি এক বার মাটির কাজ ঢোকে...!’ পঁচিশ বছর পর প্রত্যাবর্তন কুমোরটুলিতে। সে-ই গোরাচাঁদ পালের আখড়ায়।
দেখেশুনে ‘কহানি’ ছবির পরেশদার কথা মনে পড়ল। ইনফর্মার হিসেবে তিনিই তো বিদ্যা বাগচীকে পৌঁছে দিয়েছিলেন সত্যসন্ধানে!
|
|
ছবি: শাঁওলী দেব
|
ফিনিক্সের চোখে জল |
১৯৪৫ সালে আমেরিকা থেকে প্রকাশিত ‘ফিনিক্স’ পত্রিকার তরফ থেকে কুমোরটুলি কভার করতে এসেছিলেন এক প্রতিবেদক লিউইস হেইগ। সঙ্গে ছিলেন চিত্রসাংবাদিক আর্নেস্ট গুডুইন। তাঁদের ছবিতে এবং সংবাদে এ পাড়ার মৃৎশিল্পীদের জীবনযুদ্ধ সবিস্তারে পরিবেশিত হয়েছিল। মূর্তিশিল্পের মহিমা নিয়ে একবিন্দুও কালি খরচ করেননি তাঁরা। লিউইস দেখিয়েছিলেন সাধারণ মাপের একটি একচালার প্রতিমার দাম ছিল তখন পঞ্চাশ টাকা। অথচ হিসেব মতো প্রতিমা পিছু এক জন শিল্পীর কাঁচামাল এবং শ্রম বাবদ খরচ হত তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশ টাকার কাছাকাছি। শিল্পীর হাতে থাকত পনেরো-বিশ টাকা। লিউইসের পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছিল, ওই টাকা ক’টি আয় করতে শিল্পীকে একা শ্রম দিতে হত প্রায় চল্লিশ ঘণ্টা। সঙ্গে খাটতে হত তার বউ-বাচ্চা এবং ঘরের আর পাঁচ জনকে। তখন এ পাড়ায় বিদ্যুৎ আসেনি। রাতে কাজ হত মাথায় কেরোসিন তেলের লণ্ঠন বেঁধে। এত কাণ্ড করে এক জন পালমশাইয়ের এ মরসুমে রোজগার হত ৫০-৫৫ টাকা। তাঁর বিস্ময়, ‘এত কম টাকা রোজগার করে মানুষগুলি বেঁচে থাকে কী করে?’
প্রবীণ শিল্পী নিরঞ্জন পালের মুখে শোনা একটা গল্প তা হলে আর গল্প নয়। হুতোম যে কৃষ্ণনগর থেকে আসা ‘কারিকর’দের কথা বলেছেন, তারা আসতেন দল বেঁধে। নিরঞ্জনবাবু বলতেন, ‘ওঁরা আসতেন ছোট ছোট দলে। থাকত কাঠামো বাঁধার লোক, খড়ের কাজ জানা লোক আর মাটির কাজের দক্ষ কারিগর। একদল কারিগর বাড়ি বাড়ি
ঘুরে ঠাকুর গড়তেন। আর একদল কুমোরটুলিতে বা সিদ্ধেশ্বরীতলায়। যা মজুরি পেতেন প্রায় সমান ভাগেই ভাগ করে নিতেন ওঁরা। অবশ্য প্রত্যেকটি দলেই থাকত একই পরিবারের লোক।’
তা হলে কারিগর ভাড়া করে আনার প্রথা শুরু হল কোন প্রেক্ষিতে, কবে থেকে? ‘ছেচল্লিশের দাঙ্গার পর সেই ঘোর কাটিয়ে উঠতে কলকাতার সময় লেগেছিল বছর চারেক। তাই পঞ্চাশের দশক শুরু আর সর্বজনীন পুজোর দাপট একই সঙ্গে আরম্ভ হল ধরা যায়। কুমোরটুলিরও পোয়াবারো! মনে হয় কারিগর ভাড়া করার প্রথা ওই সময় থেকেই। কার্য-কারণ তা-ই বলে।’
লিউইস হেইগ বেঁচে থাকলে এখন আর পালমশাইদের জন্য চোখের জল লুকোতেন না। অন্তত ‘কুমোরটুলি মৃৎশিল্প কারিগর সমিতি’র দেওয়া তথ্যাদি হাতে পেলে। বছর পঁচিশেক বয়সের এই সমিতির খাতায় কুমোরটুলিতে কারিগর আছেন ৯৯৯ জন। এর তিরিশ শতাংশ বারো মাসের কারিগর। নাম লেখা নেই আনুমানিক ২,০০০ কারিগরের। শিক্ষানবিশী কারিগরদের দু’বেলা খাওয়া খরচা সহ মাসিক বেতন ৪,৫০০ থেকে ৬,০০০ টাকা। দক্ষ কারিগরদের ১২,০০০ থেকে ১৫,০০০ টাকা। খাটুনি দিনে আট ঘণ্টা, বেলা ন’টা থেকে একটা, এবং দুটো থেকে ছ’টা। ছ’টার পরে কাজে লাগলে প্রতি ঘণ্টায় দেড় ঘণ্টার মজুরি। এ বার কারিগরদের ঠিকানা তালিকাভুক্ত কারিগরদের সত্তর শতাংশ নদিয়া জেলার মানুষ। বর্ধমানের আছে পনেরো শতাংশ আর দুই চব্বিশ পরগনা সহ মেদিনীপুর ও মুর্শিদাবাদের কারিগর বাকি পনেরো।
সমিতির কারিগর গণনায় যে তিন হাজার মুখ ভেসে উঠছে, মানুষগুলো কুমোরটুলির কোথায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন? এ তো প্রায় জনশূন্য ভূগোল! কাজ চালানোর মতো উত্তর অবশ্য মিলল।
এই মুহূর্তে ওঁরা ছড়িয়ে রয়েছে উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, মুম্বই, দিল্লি, ত্রিপুরা, বেঙ্গালুরু, নেপাল এমনকী ইউরোপ-আমেরিকাতেও। অত দূরেও কুমোরটুলি!
|
নীড়হারা পাখি |
কারিগর সোনাই দে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ পাননি। দিল্লি-মুম্বইও না। বেলেমাটি এঁটেল মাটি ভাগাভাগি করছিলেন এক কোণে বসে। মনে বেশ স্ফূর্তি। কারণ, কণ্ঠে তাঁর গান, ‘...নীড়হারা পাখি তুমি নীড় খুঁজে ফেরো...।’ এটুকুই বোঝা গেল। কার গান গাইছেন? সোনাই বললেন, ‘রেডিয়োর গান নয়। যাত্রাপালার।’ আপনি শুনলেন কোথায়? ‘শুনব কেন, গানটা তো পশুপতির দলে আমিই গাইতাম!’ আপনি যাত্রাদলে ছিলেন? এ বার লাজুক হয়ে উঠলেন সোনাই। সহকারিগররা বললেন, ‘বীণাপানি অপেরা আর ভোলানাথ অপেরায় যুবক বয়সে মেয়ে সেজে নাচগান করতেন। অনেক গান জানেন। ও দাদু, একটা ধরো না, বেশ রসের গান!’ তাঁর লজ্জা ভাঙাতে প্রশ্ন করি, যাত্রাপালা ছেড়ে কুমোরটুলিতে এলেন কেন? সোনাই বললেন, মায়ের মৃত্যুর কথা, অভাবের কথা, আশ্রয়হীনতার কথা। কিন্তু সহকর্মীরা, ‘যাত্রার নায়িকার ল্যাঙ খেয়ে এ পাড়ায় ছিটকে পড়েছে।’
সোনাই দে-র মতো আর এক কারিগর জয়নাল আবেদিন। ঝিকিরা-জয়পুরের চিংড়াজোল গাঁয়ের মানুষ। আসলে আসবাবপত্রের কারিগর। এ পাড়ায় এসেছিলেন শোলা শিল্পী অমর ঘোষের বাড়ির ফার্নিচার মেরামত করতে। অমরবাবু তখন দু’হাতে শোলার প্রতিমা পাঠাচ্ছেন বিদেশে। তাঁর দীর্ঘ দিনের সহকর্মী পঞ্চানন দত্ত আর একা পেরে উঠছিলেন না। জয়নাল আবেদিন যোগ দিলেন অমর ঘোষের আখড়ায়। এই মুহূর্তে এখানে সুদর্শন দাস, ভীষ্ম বিশ্বাসদের দলে চমৎকার হাত লাগিয়েছেন বিদেশে রফতানি করার প্রতিমা নির্মাণে। জয়নাল মূলত প্রতিমার পিছনের চালিটি তৈরি করেন। এ মরসুমে তৈরি করে ফেলেছেন প্রায় দেড় ডজন চাল। এবং প্রতিটি প্রতিমার প্যাকেজিং তাঁর তত্ত্বাবধানে তৈরি।
সুন্দরবনের মোল্লাখালির ছেলে ভীষ্ম বিশ্বাসের কাছ থেকে পাওয়া গেল ওই অঞ্চলের এক ডাকসাইটে কারিগর সুবল মণ্ডলের হদিশ। কুমোরটুলির প্রবাদ শিল্পী গোপেশ্বর পালের ভাইপো মণি পালের সহকারী ছিলেন। সুবলকে তখন কুমোরটুলির কারিগররা বলতেন মণি পালের তৃতীয় নয়ন। কিন্তু মণি পালের প্রয়াণের পর সুবল আর কুমোরটুলিতে থাকেননি।
তবু তো কয়েক জন অন্য রকম কারিগরকে পাওয়া গেল। কিন্তু পেয়েও যারা হাতছাড়া হয়ে রইলেন! যেমন গোপেশ্বর পালের সহকারী কৃষ্ণনগরের ঘণ্টাকর্ণ পাল। ছেলে সিদ্ধেশ্বর পাল। কেনা পালের কারিগর বিভূতি সামন্ত। রমেশচন্দ্র পালের কারিগর তাঁর ভাই ও লতায়পাতায় আত্মীয়রা (যাদের নামও বলতে সংকোচ বোধ করেন রমেশবাবুর পুত্র)। এন সি পালের কারিগর বাদল পাল। এঁদের গল্প শোনানোর লোক কোথায় কুমোরটুলিতে।
এক জনের হদিস দিলেন নিরঞ্জন পাল, যিনি নিজে উত্তমকুমারের স্নেহভাজন। তাঁর বাড়ির কোজাগরী লক্ষ্মী প্রতিমার শিল্পী। টানা কয়েক বছর প্রতিমা গড়েছিলেন। বললেন, ‘শান্তিপুরের পদ পাল। কাঠামো গড়া থেকে মাটির কাজ, রঙের কাজ, অলঙ্করণ সবেতেই ওস্তাদ। বাড়ি বাড়ি ঘুরে প্রতিমা গড়তেন।’ মণি পাল ওঁর কাজের কদর করতেন। ইচ্ছে ছিল, কারিগর হিসেবে পদ পালকে নিজের কাছে রাখার। কিন্তু পদ পাল সে ভাবে থাকতে চাননি কারও কাছে।
|
|
ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
|
জীবন ভাসে ভাসান-শিল্পে |
কারিগরদের জীবনযন্ত্রণার আর এক রকম ছবি দেখিয়েছিলেন কালীঘাট পটুয়া পাড়ার অদূরে নিভৃতে মাটি নিয়ে মগ্ন এক মৃৎশিল্পী প্রফুল্ল পাল। ফরিদপুরের মানুষ। নিজেকে শিল্পী বলতে সংকোচ। বলতেন, ‘এ তো ভাসানের শিল্প! যত দেখনদারি, তা মোটে চার দিনের জন্য। মাটির ভাঁড়ের মতো, কাজ ফুরাইলে ফালাইয়া দাও।’ তাই কারিগরদের মতোই হাবভাব তাঁর। প্রতিমায় নিজে থেকে কখনও নিজের নামের পোস্টার সাঁটতেন না। সর্বজনীন কর্তারা, কেউ কেউ সেই কাজটি করে দিতেন। দক্ষিণ কলকাতার একটি মণ্ডপে বেশ কয়েক বছর ধারাবাহিক ভাবে বড় বড় ভাস্কর আর আঁকিয়েদের গড়া মূর্তির আদত কারিগর ছিলেন প্রফুল্লবাবু। মণ্ডপে কিন্তু কোথাও লেখা থাকত না এই কারিগরটির নাম। তাতে দুঃখও পেতেন না তিনি। বলতেন, ‘ওঁরা নমস্য শিল্পী, লোকে ওঁদের চিনবে। আমাদের কারিগরদের চিনে কী হবে?’
কারিগরদের চেনার প্রক্রিয়াটির সূচনা করেছিলেন গবেষক অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। একদা দশঘরার বিশ্বাস পরিবারের সঙ্গে পরিচিত হয়ে তিনি কুমোরটুলির বহু পুতুলের কারিগরদের সন্ধান পান। তাঁদেরই অন্যতম তারাপদ পাল। এই তারাপদই এক নাগাড়ে শোভাবাজার রাজবাড়ির প্রতিমা গড়তেন। তাঁর নাতি দিলীপ পালের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল বছরখানেক আগে। দিলীপ পাল জানতেন না ১৯৩৭-৩৮ নাগাদ তাঁর দাদু কী অসাধ্য সাধন করেছিলেন দশঘরায়। বিশ্বাস পরিবারের গৃহদেবতার টেরাকোটার মন্দিরটি তিনি সংস্কার করেছিলেন তাঁর মেঠো প্রতিভা দিয়ে।
কারিগরদের এই মেঠো প্রতিভার কথা শত মুখে শুনেছি পুরনো বাংলা ছায়াছবির সেট ডিজাইনার নিরঞ্জন পালের কাছে। শুধু ছবির সেট নির্মাণই নয়, বড় বড় প্রাচীন বাড়ির অলঙ্করণের কাজ জানতেন এ পাড়ার কারিগররা। ছাদের কার্নিশে লতাপাতার ডিজাইন, রকমারি ভঙ্গির নারীমূর্তি, সিংহদরজার উপর ব্রিটিশ সিংহ বা মকরমুখ তৈরির কাজে অসম্ভব দক্ষ ছিলেন এই কারিগররা। শহরের অনেক বাড়িতেই সিমেন্ট চুন-বালি-সুরকির সেই সব নমুনা চোখে পড়ে এখনও। কিন্তু হারিয়ে গিয়েছে তাঁদের নাম, তাঁদের পরিচয়, তাঁদের বংশসূত্র, তাঁদের দক্ষতার ইতিবৃত্ত।
প্রফুল্ল পালের মতবাদটাই হয়তো সত্যি। যে শিল্প চার দিনের বেশি টিকে না, তার শিল্পী বা কারিগরদের টিকিয়ে রাখার প্রয়োজন কোথায়? ওঁরা ভাসতে ভাসতে কুমোরটুলিতে এসে কয়েক দিনের অতিথি হয়ে ওঠেন, আবার মরসুম শেষে ফিরে যান ভাসতে ভাসতে। জীবন ভাসে ভাসান-শিল্পে। শচীনকর্তা হয়তো এই দর্শনটির সঙ্গে একটু সুর বসিয়ে জুড়ে দিতেন বাইয়া যাও, বাইয়া যা-ও রে... |
|
|
|
|
|