বদলই পথ, না মেরামতি,
প্রশ্ন হৃদ্রোগ চিকিৎসায়
রোগীর পক্ষে কোনটা ভাল, সেটা নিয়েই প্রশ্ন।
হৃদযন্ত্রের মাইট্রাল ভালভ প্রতিস্থাপন নাকি পুরনো ভালভের মেরামতি? চিকিৎসার খরচ থেকে শুরু করে আয়ু, কোন দিকে রোগীর সুবিধার পাল্লা ভারী? বিদেশে ভালভ মেরামতির দিকেই ঝুঁকেছেন চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ। কিন্তু এ দেশে, বিশেষত পূর্বাঞ্চলে ভালভ মেরামতি চালু হয়েও তেমন জনপ্রিয় হতে পারছে না।
হৃদযন্ত্রের বাঁ দিকের অলিন্দ আর নিলয়ের মাঝখানে থাকে মাইট্রাল ভালভ। নানা কারণে এই ভালভ অকেজো হয়ে যেতে পারে। কখনও ভালভ সরু হয়ে যাওয়ায় রক্ত চলাচলে সমস্যা হয়, কখনও বা ভালভ ফুটো হয়ে রক্তপ্রবাহের স্বাভাবিক গতিকে নষ্ট করে। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, বহু দিন পর্যন্ত এই সমস্যার একটাই সমাধান ছিল ভালভ প্রতিস্থাপন। আসল মাইট্রাল ভালভ সরিয়ে ধাতব মাইট্রাল ভালভ বসানো। কিন্তু গত বেশ কয়েক বছর ধরে মাইট্রাল ভালভ মেরামতির উপরে বেশি জোর দিচ্ছে উন্নত দেশগুলি। চিকিৎসার খরচ এবং রোগীর স্বাস্থ্য, দু’দিক থেকেই তা বেশি সুফলদায়ী বলে মনে করা হচ্ছে।
দুর্গাপুরের একটি হাসপাতালের চেয়ারম্যান, কার্ডিওথোরাসিক সার্জন সত্যজিৎ বসুর বক্তব্য, যাঁদের দেহে ধাতব ভালভ বসানো হয়, তাঁদের মধ্যে ৫০ শতাংশ মানুষই ১০ বছরের বেশি বাঁচেন না। তাই আয়ু বাড়ানোর স্বার্থেও ভালভ মেরামতিটা খুব জরুরি। পাশাপাশি কমবয়সীদের ক্ষেত্রে ধাতব ভালভ বসালে স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ক্ষেত্রেও নানা বিধিনিষেধ তৈরি হয়। যেমন? সত্যজিৎবাবু বলেন, “রক্ত পাতলা হওয়ার ওষুধ বরাবর খেয়ে যেতে হয়। এ ক্ষেত্রে ডোজটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কম খেলে সমস্যা, আবার বেশি খেলেও থ্রম্বোসিস হয়ে মৃত্যু হতে পারে।” কমবয়সী মেয়েদের ক্ষেত্রে এই ওষুধের আরও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। আরজিকর মেডিক্যাল কলেজের কার্ডিওথোরাসিক বিভাগের প্রধান চিকিৎসক ভবতোষ বিশ্বাস জানান, এর ফলে সন্তানধারণে সমস্যা হয়। এমনকী ঋতুকালীন সময়েও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের জেরে নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে।
তা হলে এখানে এখনও ভালভ মেরামতির পদ্ধতি জনপ্রিয় নয় কেন?
কিছু ক্ষেত্রে ভালভ প্রতিস্থাপন ছাড়া গত্যন্তর থাকে না ঠিকই। কিন্তু যে ক্ষেত্রে ভালভ মেরামত করা সম্ভব, সে ক্ষেত্রেও চিকিৎসকরা তা করতে চান না কেন?
বিশেষজ্ঞদের মতে, বেসরকারি হাসপাতালগুলির তরফে এ ব্যাপারে অনীহার দু’টো কারণ রয়েছে। ভালভ মেরামতিতে চিকিৎসার খরচ ৬০-৭০ হাজার টাকা কম হয়ে থাকে। বেসরকারি হাসপাতালগুলি নিজেদের মুনাফার স্বার্থেই মেরামতিতে যেতে চায় না।
আর একটি প্রতিবন্ধকতা হল, দক্ষতার অভাব। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, ভালভ মেরামতির জন্য যে দক্ষতা প্রয়োজন হয়, তা অনেক চিকিৎসকেরই নেই। ভবতোষবাবুর মতে, ভালভ মেরামতির কাজটা আসলে ছেঁড়া শাড়ি তালি দেওয়ার মতো। দক্ষতা না
থাকলে তালি ঠিকঠাক দেওয়া যায় না। কিন্তু রোগীর সুস্বাস্থ্যের জন্য, “প্রতিস্থাপনের চেয়ে মেরামতি বহু গুণ ভাল। বিশেষত কমবয়সী রোগীদের ক্ষেত্রে প্রতিস্থাপন করাই উচিত নয়।” বেসরকারি হাসপাতালের তুলনায় সরকারি হাসপাতালে ভালভ মেরামতি বেশি হয় বলে ভবতোষবাবুর দাবি।
বেসরকারি হৃদরোগ হাসপাতালের ভাইস প্রেসিডেন্ট, কার্ডিওথোরাসিক সার্জন কুণাল সরকারের যুক্তি অবশ্য ভিন্ন। তাঁর মতে, পাশ্চাত্যে মাইট্রাল ভালভ নষ্ট হয় প্রধানত ডিজেনারেটিভ হার্ট ডিজিজের (ক্ষয়জনিত সমস্যা) কারণে। কিন্তু এ দেশে রিউম্যাটিক (বাতজনিত সমস্যা) হার্ট ডিজিজের জেরেই ভালভ নষ্ট হওয়ার ঘটনা বেশি। রিউম্যাটিক হার্ট ডিজিজের ক্ষেত্রে ভালভ শুকিয়ে, গুটিয়ে ছোট হয়ে যায়। গায়ে ক্যালসিয়াম জমে শক্ত হয়ে যায়। ফলে মেরামতি কঠিন তো বটেই, এমনকী কখনও কখনও অসম্ভব হয়ে পড়ে। তিনি বলেন, “আমাদের দেশে ইস্কিমিক হার্টের কারণে অনেক সময়ে ভালভ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেগুলির ক্ষেত্রে প্রতিস্থাপন না করে আমরা মেরামত করে দিই।” তাঁদের হাসপাতালে বছরে অন্তত ৫০টি ইস্কিমিক মাইট্রাল ভালভ মেরামত হয় বলে দাবি কুণালবাবুর। এ দেশে কিছু ক্ষেত্রে কমবয়সীদের মধ্যে ডিজেনারেটিভ হার্ট ডিজিজ পাওয়া যাচ্ছে। সেগুলিতেও ভালভ মেরামত করা যায়। গুজরাত, অন্ধ্রপ্রদেশের মতো রাজ্যে চিকিৎসা বিমা রয়েছে, স্কুল স্তরে স্ক্রিনিংও চালু রয়েছে। তাই রোগ ধরাও পড়ছে। কুণালবাবুর মতে, “পশ্চিমবঙ্গ-সহ বেশির ভাগ জায়গাতেই সেই ব্যবস্থা নেই। রোগ সময়ে ধরা পড়ে না। মেরামতির সুযোগও থাকে না।”
রিউম্যাটিক ভালভের ক্ষেত্রে তবে কি মেরামতির কোনও আশা নেই?
ভবতোষবাবু মানছেন যে, রিউম্যাটিক হার্টের রোগীদের ক্ষেত্রে কাজটা শক্ত। কিন্তু অসম্ভব নয়। এ দেশে যেহেতু এই জাতীয় রোগীর সংখ্যাই বেশি, তাই রিউম্যাটিক মাইট্রাল ভালভ মেরামত করা না গেলে এই চিকিৎসা পদ্ধতি জনপ্রিয় হওয়া মুশকিল, বলছেন তিনি। সত্যজিৎবাবুর কিন্তু দাবি, তাঁরা বছরে গড়ে ২৫০ থেকে ৩০০ ‘রিউম্যাটিক মাইট্রাল ভালভ’ই মেরামত করে থাকেন। তাঁর কথায়, “বিশেষ পদ্ধতিতে রিউম্যাটিক হার্টের ক্ষেত্রেও যে ভালভ মেরামতি সম্ভব, তা আমরা দেখিয়ে দিচ্ছি। চিকিৎসা পরিভাষায় একে বলে ‘পেরিকার্ডিয়াল অগমেন্টেশন অফ পস্টেরিয়র লিফলেট অফ মাইট্রাল ভালভ’।”
তবে একটা ব্যাপারে সব বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকই একমত। সেটা হল, চিকিৎসকের দক্ষতার উপরেই নির্ভর করছে মেরামতির সাফল্য। এসএসকেএম হাসপাতালের হৃদরোগ চিকিৎসক বিশ্বকেশ মজুমদার বললেন, “ভালভ মেরামতি সফল না হলে কিন্তু ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। কয়েক জন হৃদরোগীকে ভালভ মেরামতির জন্য কার্ডিওথোরাসিক চিকিৎসকের কাছে রেফার করেছিলাম। তাঁদের অনেকেরই প্রথম অস্ত্রোপচারের দু’তিন বছর পরে ফের অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে।” বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকেরাও অনেকে বলছেন, বহু ক্ষেত্রে মাইট্রাল ভালভ এক বার মেরামতি করার কয়েক বছর পরে ফের মেরামতির পরিস্থিতি আসতে পারে। সেই জটিলতায় যেতে চাইবেন না অনেকেই। তবে ভবতোষবাবু এবং সত্যজিৎবাবুর মতে, চিকিৎসক সুদক্ষ হলে বারবার অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হবে না। স্থায়ী সমাধান মিলবে।
হৃদরোগীরা তবে কোন পদ্ধতির দিকে ঝুঁকবেন?
এ ক্ষেত্রে ভালভ মেরামতির বিষয়ে রোগীদের সচেতনতা বাড়ানোর উপরেই গুরুত্ব দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তখন ভালভ মেরামতির সুযোগ থাকলেও প্রতিস্থাপনের পথে হাঁটার আগে প্রশ্ন তুলতে পারবেন তাঁরা। পাশাপাশি চিকিৎসকের দক্ষতার দিকটিও যাতে নজর এড়িয়ে না যায়, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে তাঁদের।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.