আইন রয়েছে। তাতে জামিন-অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা এবং জেল-জরিমানার কথাও বলা আছে। তবু কাজের কাজ যে হচ্ছে না, শুক্রবার সকালে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ঘটনা ফের তা প্রমাণ করে দিল।
এক রোগীর মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে তার পরিবারের লোকেদের ক্ষোভপ্রকাশ দিয়ে যে গোলমালের সূত্রপাত হয়েছিল, তা চরম আকার নেয় ম্যাটাডর বোঝাই হয়ে এসে বহিরাগতদের আক্রমণে। প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে কয়েকশো লোক হাসপাতালের ইমার্জেন্সি, আউটডোরে হামলা চালায়। তছনছ হয়ে যায় চিকিৎসার বিভিন্ন সরঞ্জাম। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে রোগীদের মধ্যেও। এই ঘটনায় হাসপাতালের পাঁচ জন কর্মী-সহ আহত হয়েছেন দুই পুলিশকর্মীও। প্রায় চার ঘণ্টা হাসপাতালে পরিষেবা বন্ধ থাকে। এই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ ১৮ জনকে গ্রেফতার করেছে। ধৃতদের শিয়ালদহ আদালতের অতিরিক্ত মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট অরুণ রাইয়ের এজলাসে হাজির করানো হলে তাদের মধ্যে ১৭ জনকে ২২ অগস্ট পর্যন্ত পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন বিচারক। এক জনের জেল হেফাজত হয়েছে। |
ঘটনার সূত্রপাত সকাল সাতটা নাগাদ। দমদম ক্যান্টনমেন্ট অঞ্চলে মাঠকলের প্রমোদনগরের বাসিন্দা সন্তু রায় (১৫) নামে এক কিশোরের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই উত্তেজনা দেখা দেয়। গত বুধবার ফুটবল খেলতে গিয়ে পায়ে চোট পেয়েছিল সন্তু। ব্যথা বাড়ায় ওই দিনই তাকে আর জি করে ভর্তি করানো হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার রাতে মেরুদণ্ডে অস্ত্রোপচারের জন্য সন্তুকে অ্যানাস্থেশিয়া দেওয়ার পরেই তার খিঁচুনি শুরু হয়। পরে কোমায় চলে যায় সে। এ দিন ভোরে সন্তুর মৃত্যু হয়। এর পরেই মৃতের পরিজনেরা হাসপাতালে এসে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। সন্তুর মা আশা রায়ের অভিযোগ, তাঁর ছেলের কোনও চিকিৎসাই হয়নি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, পরিস্থিতি সামাল দিতে ফাঁড়ি থেকে কয়েক জন পুলিশকর্মী এলেও তাঁরা কিছুই করতে পারেননি। কারণ, ততক্ষণে কয়েকটি ম্যাটাডরে চড়ে একশোরও বেশি যুবক লাঠি, সাইকেলের চেন, ইট-পাথর নিয়ে ক্যাশ কাউন্টার, এমআরআই এবং জরুরি বিভাগের কম্পিউটার, আলো, সিলিং ফ্যান, দরজা-জানলার কাচ ভাঙচুর শুরু করেন। তছনছ করা হয় ইমার্জেন্সি বিভাগের বিভিন্ন সরঞ্জামও। জরুরি বিভাগ কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। বেধড়ক মারধর করা হয় পুলিশ এবং হাসপাতালের জরুরি বিভাগের কর্মীদের। পরিস্থিতি সামাল দিতে শুধু টালা থানা নয়, আশপাশের অন্যান্য থানা থেকেও পুলিশবাহিনী আনা হয়। পুলিশের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ শুরু হয় রোগীর পরিজনেদের। লাঠি চালায় পুলিশ। ডিসি (নর্থ) গৌরব শর্মা বলেন, “প্রায় শ’দুয়েক লোক অস্ত্র নিয়ে এসে ইমার্জেন্সি, আউটডোর থেকে শুরু করে অপারেশন থিয়েটার পর্যন্ত ভাঙচুর করেছে। দুই পুলিশকর্মী বিদ্যুৎকুমার রায় ও জ্যোর্তিময় বারুই গুরুতর আহত।” |
আর জির কর হাসপাতালের ডেপুটি সুপার সিদ্ধার্থ নিয়োগী জানিয়েছেন, সন্তুর চিকিৎসায় আদৌ কোনও গাফিলতি ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিনি বলেন, “অভিযোগ থাকলে তা রোগী বা তাঁর পরিবারের লোকেরা জানাতেই পারেন। কিন্তু অভিযোগের নামে হাসপাতালে তাণ্ডব চালালে তাতে বাকি রোগীদেরও যে ক্ষতি হয়, এটা বুঝতে হবে। হাঙ্গামা বাধানোটা কোনও রকম সমাধানের পথ হতে পারে না।”
হাসপাতালের এক প্রবীণ চিকিৎসক অবশ্য জানিয়েছেন, বাড়ির লোকজনকে রোগীর শারীরিক অবস্থা ভাল ভাবে বুঝিয়ে না বললে এমন ঘটনা বন্ধ করা যাবে না। তিনি বলেন, “এ ক্ষেত্রেও ছেলেটির ঠিক কী হয়েছিল, অবস্থা কতটা গুরুতর ছিল, সে বিষয়ে বাড়ির লোকেদের কিছুই জানানো হয়নি। আচমকা রোগীর মৃত্যুর খবর পেলে এমন উত্তেজনা তৈরি হতে পারে।” রোগী-চিকিৎসকের মধ্যে আরও বেশি যোগাযোগ থাকা বাঞ্ছনীয়।”
রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “চিকিৎসায় গাফিলতি ঘটলে তার তদন্ত হবে, যথাযথ ব্যবস্থাও নেওয়া হবে। ইদানীং কর্তব্যে গাফিলতির জন্য বেশ কিছু চিকিৎসক ও হাসপাতালকর্মীকে সাসপেন্ডও করা হয়েছে। কিন্তু গাফিলতির অভিযোগ তুলে এমন হামলা কখনওই বরদাস্ত করা হবে না। এমন ঘটনা কোনও সভ্য সমাজে ঘটতে পারে না।”
স্বাস্থ্যকর্তারা ‘বরদাস্ত’ না করার কথা বললেও এমন ঘটনা কিন্তু ঘটেই চলেছে। মাস দেড়েক আগে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে রোগীর পরিজনদের গোলমালের জেরে লাগাতার কর্মবিরতিতে সামিল হয়েছিলেন সেখানকার জুনিয়র ডাক্তারেরা। যার জেরে টানা পাঁচ দিন ব্যাহত হয়েছিল পরিষেবা। অন্যান্য বারের মতো সে বারও পুলিশের সঙ্গে বৈঠকে বসে নিরাপত্তা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন হাসপাতাল কতৃর্পক্ষ এবং স্বাস্থ্যকর্তারা। কিন্তু মাসখানেক পেরোতে না পেরোতেই ফের যে কে সে-ই অবস্থা। ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ওই হামলার ঘটনায় অভিযুক্তেরা গ্রেফতার হয়েছিল, তার পরে আদালত থেকে সকলেই জামিন পেয়ে যায়।
আর জি কর সূত্রের খবর, এ দিন সকালে ফাঁড়িতে পুলিশের শিফ্ট বদলের সময়েই গোলমাল শুরু হয়। তখন মাত্র পাঁচ জন পুলিশকর্মী ছিলেন। স্বাস্থ্য দফতরের নিযুক্ত নিরাপত্তাকর্মীরাও সকলে তখনও এসে পৌঁছননি। কার্যত আত্মরক্ষার কোনও সুযোগই পাননি হাসপাতালকর্মীরা। বাধা দিতে গিয়ে গুরুতর আহত হন দুই পুলিশকর্মী। তাঁদের মধ্যে এক জনের অবস্থা গুরুতর। তাঁর মাথায় আঘাত লেগেছে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, কোনও গোলমালের পরে পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো হয় ঠিকই, কিন্তু তা কার্যত চোখে ধুলো দেওয়ারই সামিল। কারণ, কয়েক দিন না যেতেই ফের তাঁদের অন্যত্র তুলে নেওয়া হয়। পাশাপাশি, চুক্তির ভিত্তিতে নিযুক্ত মাত্র ৭০ জন নিরাপত্তাকর্মীকে দিয়ে এত বড় হাসপাতালে তিনটি শিফ্টে কাজ করানো কার্যত হাসপাতাল অসুরক্ষিত রাখারই সামিল বলে মেনে নিয়েছেন তাঁরা। |