আকাশের মুখ ভার দেখলেই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছেন মহানন্দা ব্যারেজ কর্তৃপক্ষ। রাতভর বৃষ্টিতে নদীর ধারে থাকা এলাকায় জল উঠতে দেখলেই পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তারা তো বটেই, সাধারণ বাসিন্দারাও মহানন্দা ব্যারেজ কর্তৃপক্ষকে ফোন করছেন ব্যারেজের গেট খোলা রাখতে। বন্যা পরিস্থিতির কথা ভেবে ব্যারেজের গেটগুলি বেশি খোলা রেখে জল বের করে দিলেও বিপত্তি। নির্দিষ্ট জলস্তর না-থাকলে তিস্তা মহানন্দা লিঙ্ক ক্যানেল থেকে ফুলবাড়ি ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে পানীয় জল সংগ্রহের ক্ষেত্রে সমস্যা হবে। শহরের বাসিন্দাদের পানীয় জল সরবরাহ ব্যহত হয়ে পড়বে। নদীর জল বাড়তে ভোর রাতে তাই কখনও মেয়র ফোন করে বলছেন, ‘ব্যারেজের গেটগুলি যাতে ঠিক মতো খোলা রাখা হয়, জল না জমে একটু দেখবেন।’ দুপুরের মধ্যেই বৃষ্টি কমতেই ফের মেয়রের ফোন ব্যারেজ কর্তৃপক্ষের কাছে। এ বার সুর বদল। ‘শহরের বাসিন্দাদের পানীয় জল পেতে যাতে সমস্যা না হয় একটু দেখবেন।’ মূলত এই দুই সমস্যা সামাল দিতে চোখের ঘুম উড়ে গিয়েছে মহানন্দা ব্যারেজ কর্তৃপক্ষের। নদীর জল বাড়তেই ব্যারেজের গেট খুলে একদিকে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে। অন্য দিকে গেট নিয়ন্ত্রণ করে নির্দিষ্ট জলস্তর ঠিক রেখে শহরের বাসিন্দাদের পানীয় জল সরবরাহে যাতে সমস্যা না হয় তা দেখতে হচ্ছে। নজরদারির সামান্য হেরফের হলেই বিপত্তি। ফুলবাড়ি ব্যারেজে তাই বাড়তি নজরদারি করতে হচ্ছে তাদের। অতিমাত্রায় সতর্ক থাকতে হচ্ছে। মহানন্দা ব্যারেজের শিলিগুড়ি ডিভিশনের কার্যনির্বাহী আধিকারিক কৃষ্ণেন্দু ভৌমিক বলেন, “ফুলবাড়ি ব্যারেজের কনট্রোল রুমে এই সময় তাই ২৪ ঘন্টাই কর্মরত থাকতে হচ্ছে অন্তত একজন সহকারি বাস্তুকারকে। তার উপর সমস্যা বাড়িয়েছে উজানে বালাসন এবং মহানন্দায় সিগন্যালিং ব্যবস্থা না থাকা। পাহাড়ে বা উজানে বৃষ্টিপাতের ফলে কতটা জল নেমে আসছে, বাড়তি জল বের করে দিতে ব্যারেজের গেট কতটা খোলা রাখা উচিত তা আগাম হিসাব করা সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের তাই বাড়তি সতর্ক থাকতে হচ্ছে।” কার্যত ব্যারেজের গেট খোলা-বন্ধ নিয়ন্ত্রণ করতে এক প্রকার নাজেহাল অবস্থা তাদের। মহানন্দা ব্যারেজ সূত্রেই জানা গিয়েছে, শিলিগুড়ি শহরে পানীয় জল সরবরাহের জন্য তিস্তা-মহানন্দা লিঙ্ক ক্যানেল থেকে জল তোলা হয়ে থাকে। সে জন্য ফুলবাড়িতে মহানন্দা ব্যারেজে জলস্তরের উচ্চতা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ১০৬.৮০ মিটার রাখতে হচ্ছে। ভোর ৬ টা থেকে প্রায় বেলা ২ টা পর্যন্ত জল তোলা হয়। দ্বিতীয় দফায় বেলা সাড়ে ৪ টা থেকে জল তোলা শুরু হয়। জলস্তরের উচ্চতা এর নিচে নামলে ফুলবাড়ি ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে জল তোলার কাজে সমস্যা হবে। ব্যারেজের মেঝে বা ভূপৃষ্ঠের উচ্চতা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ১০৩.৮৪৫ মিটার। অর্থাৎ প্রায় ৩ মিটারের মতো গভীর জলস্তর ধরে রাখা জরুরি। অথচ ওই জলস্তর ধরে রাখার পর পাহাড়ে বা উজানে ভারি বৃষ্টির হলে মহানন্দায় আচমকা জলস্তর বেড়ে যাচ্ছে। মহানন্দার ধারে নদীর ধারে থাকা পুরসভার ১-৫, ৩১, ৪১-৪৬ নম্বর ওয়ার্ডগুলির এলাকাংশ জলমগ্ন হয়ে পড়ছে। বালাসন নদীর জলও এসে পড়ছে মহানন্দায়। তার জেরে এক দেড় ঘন্টা ব্যারাজের গেট ঠিক মতো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলে পশ্চিমধনতলা এবং লাগোয়া এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়ছে। গত ১৫ জুলাই ভোর রাতে ব্যারেজ কর্তৃপক্ষ জল ছাড়তে দেরি করায় সে সমস্যা দেখা দেয়। মহানন্দা ব্যারেজ কর্তৃপক্ষ জানান, রাত দেড়টার পর থেকে বিদ্যুৎ না থাকা, জেনারেটর চালিয়ে সময় মতো ব্যারেজের গেট খুলতে পারেননি তারা। পশ্চিম ধনতলা জলমগ্ন হয়ে শতাধিক পরিবার মহানন্দা বাঁধে আশ্রয় নেয়। নদীর ধারে থাকা শিলিগুড়ি পুরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ডে জল ঢুকে পড়ে। মহানন্দা ডিভিশনের সুপারিটডেন্টেন্ড ইঞ্জিনিয়ার শ্যাম বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, শিলিগুড়ি শহরের পানীয় জল সরবরাহের পাশাপাশি লিউচিপাখরি, হপতিয়াগছ এবং ভোলাগছ এলাকায় তিনটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য ব্যারেজ থেকে ৮০-১০০ কিউমেক জল ছাড়ার বিষয়টিও খেয়াল রাখতে হয়। এই বিষয় দুটি না থাকলে বর্ষায় ব্যারেজে জলস্তর ১০৫ মিটার (সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে) -এ রাখা গেলে সমস্যা হত না। |