|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ২... |
|
ছোট্ট মেয়েটির মুচকি হাসি আজও অম্লান |
গৌতম চক্রবর্তী
|
আমুলস ইন্ডিয়া। কলিন্স বিজনেস, ২৯৯.০০ |
ঝকঝকে ছাপা ২১২ পৃষ্ঠার পেপারব্যাকটি মাখনের মতোই মসৃণ ও সুস্বাদু। ‘আটারলি, বাটারলি, ডিলিশাস!’
ইংরেজি ‘বাটারলি’ শব্দটি অবশ্য ব্যাকরণসম্মত নয়। কিন্তু সৃজনপ্রতিভা কবে ব্যাকরণ মেনেছে? ষাটের দশকে আমুল মাখনের বিজ্ঞাপন তৈরির দায়িত্ব পায় মুম্বইয়ের ‘অ্যাডভার্টাইজিং অ্যান্ড সেলস প্রোমোশন কোম্পানি’। গুজরাতের আনন্দ-এ গোপালকদের সমবায় সংস্থায় তৈরি বিশুদ্ধ মাখন। সব মাখনই তো স্বাস্থ্যসম্মত, বিশুদ্ধ। তা হলে? বিজ্ঞাপনী সংস্থার প্রধান সিলভেস্টার ডা’ কুনহা তা নিয়েই স্ত্রী নিশার সঙ্গে কথা বলছিলেন। বাড়িতে ঘি, মাখন কেনা বউদের দায়িত্ব। ফলে, এ বিষয়ে তাদের মতামত সবচেয়ে বিশ্বাস্য।
নিশা মুম্বইয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ইংরেজির শিক্ষিকা। স্বামীকে আচমকা জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘আটারলি আমুল’ বললে কেমন হয়?” সিলভেস্টার সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন, ‘কেন, আটারলি বাটারলি? আরও ভাল।’ পরের দিন বিজ্ঞাপন-সংস্থায় তুমুল হইচই। বাটারলি শব্দটার কোনও মানে নেই। লোকে কিছু বুঝবে না। অবশেষে মাখন প্রস্তুতকারক সংস্থার প্রধান ভার্গিজ কুরিয়েন জানালেন, ‘বাটারলি শব্দটা পাগলামি। কিন্তু আপনি যদি মনে করেন লোকে খাবে, এগিয়ে যান।’ ব্যস, ইউস্টাস ফার্নান্ডেজ এঁকে ফেললেন লাল পোলকা ডটের ফ্রক পরা এক মেয়ে। মাথায় রিবন।
তার পর পঞ্চাশ বছর ধরে বহু জল গড়িয়েছে। নেহরু-অর্থনীতি থেকে ভারত পৌঁছে গিয়েছে মনমোহনী অর্থনীতিতে। ব্রেকফাস্টের টেবিলে মাখন- টোস্টের পাশে এসেছে পিত্জা, হটডগ, বার্গার। বিজ্ঞাপনের জগতেও বহু বদল। এয়ার ইন্ডিয়ার ‘মহারাজা’ বিদায় নিয়েছে। ওনিডার দুই শিংওয়ালা ‘শয়তান’ হারিয়ে গিয়েছে স্মৃতির নরকে। কিন্তু হাতে-আঁকা মেয়ে আর তার মুচকি হাসি আজও অম্লান।
এই যে এত দিন ধরে একটি পণ্যের মুখ একই রকম... এটি বিজ্ঞাপনে বিশেষ ঘটে না। এখনও ডা’ কুনহা-রাই ওই বিজ্ঞাপন বানান। স্টাইলও বদলায়নি। সমসাময়িক ঘটনা নিয়ে ছোট্ট মেয়েটির মুচকি হাসি। বিজ্ঞাপনের ইতিহাসে এটিও এক দিকচিহ্ন!
গত পাঁচ দশকে আমুলের বাছাই করা ২৫০ বিজ্ঞাপন আর কয়েকটি লেখা আর সাক্ষাৎকারকে দুই মলাটের মধ্যে এনে এই বইও সে রকমই এক দিকচিহ্ন। বই পড়ে বোঝা গেল, আমুল-কন্যা দুই প্রজন্ম ধরে উজ্জ্বল। শোভা দে, শ্যাম বেনেগল, অ্যালেক পদমজির পাশাপাশি রাহুল দ্রাবিড়, সানিয়া মির্জা থেকে রাজদীপ সরদেশাই, মিলিন্দ দেওরা এক বাক্যে জানিয়েছেন, ছোটবেলায় আমূলের বিজ্ঞাপন ভাল লাগত। পরে আরও ভাল লাগল, যখন তাঁদের নিয়েও মজা করা হল। কংগ্রেস নেতা মিলিন্দ জানিয়েছেন, তাঁর অন্যতম প্রিয় আমুল-বিজ্ঞাপন: সনিয়া গাঁধী, করুণানিধি, মুরলি দেওরা সকলে পুত্রদের খেলনা গাড়ি চড়াচ্ছেন। ওপরে ক্যাচলাইন: ‘বেটা বন গ্যয়া নেতা। নীচে লেখা, আমুল ফ্যামিলি প্যাক।’
সবাইকে নিয়ে মজা করার এই ‘ইররেভারেন্ট’ মানসিকতাটাই আমুলের বিজ্ঞাপনী জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ। নেতা, চিত্রতারকা, ক্রীড়াবিদদের আর পাঁচ জনের মতো একই সমতলে দাঁড় করিয়ে দেওয়া, তাঁদের সাম্প্রতিক উক্তি বা ঘটনা নিয়ে মজা করাই তো সাধারণ মানুষের চোখ টেনেছে। বিখ্যাতদের নিয়ে মজা মানে, আমি নিজেকে নিয়ে মজা করছি। ‘যারা মজা দেখে হাসে, কার্নিভালের হাসি আসলে তাদের দিকেই ধাবিত হয়,’ লিখেছিলেন বাখতিন।
নিজেকে নিয়ে হাসার সুযোগ আমুল আমাদের দিয়েছিল। অমিতাভ বচ্চন জানিয়েছেন, যখনই তাঁকে নিয়ে ‘আমুল আকবর অ্যান্থনি’ গোছের বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে, সেটি জমিয়ে রেখেছেন। এই বইয়ে আছে ‘দিওয়ার’ ছবির ঢঙে আমুলের বিজ্ঞাপন। এক দিকে মুকেশ অম্বানী, অন্য দিকে অনিল। মাঝে তাঁদের মা কোকিলাবেন। নীচে ক্যাচলাইন, ‘মেরে পাস মাস্কা হ্যায়।’ অম্বানীরা রেগেও যাননি, মামলাও করেননি।
তখন জরুরি অবস্থা। সঞ্জয় গাঁধীর নাসবন্দি প্রকল্প জোর কদমে। আমুল-কন্যা বিজ্ঞাপনে এল হাসপাতালের সেবিকার বেশে। হাতের ট্রে-তে বড় মাখনের প্যাকেট। সঙ্গে স্লোগান: ‘বাধ্যতামূলক স্টেরিলাইজেশন আমরা সবসময়েই পালন করি।’ বিজ্ঞাপন সংস্থার কর্ণধার রাহুল ডা’ কুনহা লিখেছেন, এই বিজ্ঞাপনগুলি করতে তাঁরা এক মিনিটও ভাবেননি। কিন্তু এখন ভাবতে হয়। ভারতীয় গণতন্ত্রে কি সহনশীলতা ক্রমে কমছে? তাত্ত্বিকরা ভেবে দেখতে পারেন।
সহনশীলতা কমেছে, নিরাপত্তাবলয় বেড়েছে। বইয়ে একটি ঘটনার কথা আছে। ১৯৬৪। গো-খাদ্যের প্লান্ট উদ্বোধনের জন্য আনন্দ-এ প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তখন ব্ল্যাক ক্যাট, মিডিয়া ইত্যাদির এত রমরমা নেই। শাস্ত্রী সবাইকে হঠিয়ে এক রাত রমণভাই নামের এক চাষির কুঁড়েঘরে থাকলেন। পরদিন সকালে তিনি উচ্ছ্বসিত। কুরিয়েনকে বললেন, ‘সারা দেশে এ রকম ডেয়ারি ডেভেলপমেন্ট বোর্ড তৈরি করতে হবে। আপনি দায়িত্ব নিন।’ কুরিয়েন শর্ত দিলেন, ‘বোর্ডের সদর দফতর কিন্তু দিল্লিতে নয়, এখানে আনন্দ গ্রামে করতে হবে।’ সমবায় থেকে শ্বেত বিপ্লব, আনন্দ গ্রামের শহর হয়ে ওঠা... আধুনিক ভারতের ইতিহাসের এক অধ্যায় লুকিয়ে আছে ’৬৪-র সেই রাতে।
পঞ্চাশ বছরের বিজ্ঞাপনী ইতিহাসের আর এক দিক, দেশজ ভাষার স্বীকৃতি। ইংরেজি শিক্ষিতদের বাইরেও তো রয়ে গিয়েছেন উপভোক্তাদের বড় অংশ। অতএব, রোমান হরফে বাংলা ভাষা মিশিয়ে বিজ্ঞাপন বেরোল কলকাতা শহরে। ‘আমূল ছাড়া টোস্ট? চলবে না। চলবে না।’ কলকাতায় তখন কথায় কথায় ‘চলছে না, চলবে না’ স্লোগান।
|
|
|
|
|
|