|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
ওঁরা থেমে থাকেননি, মেনে নেননি |
সেমন্তী ঘোষ |
দে ডেয়ারড/ এসেজ ইন অনার অব প্রীতিলতা ওয়াদ্দার,সম্পা: সীমন্তী সেন। গাঙচিল, ৪৭৫.০০ |
প্রীতিলতা ওয়াদ্দার, বীণা দাস, নিরুপমা দেবী, জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, কানন দেবী, মঞ্জুশ্রী চাকী সরকার, বিনোদিনী দাসী, বেবি হালদার..। নামগুলি পর পর সাজালে একটু অবাকই লাগে। তবে বিস্ময়ের সিঁড়ি দিয়ে আর দু-এক ধাপ গভীরে নামলেই স্পষ্ট, এঁদের প্রত্যেকের মধ্যে বহমান অদৃশ্য একটি যোগসূত্র: আলাদা আলাদা ক্ষেত্রে নারীর পদচিহ্ন দৃপ্ত ভাবে এঁকে দিয়েছিলেন এঁরা, অনতিসহজ লড়াই-এর পথ ধরে। কেউ প্রকাশ্যতই শক্তিরূপেণ সংস্থিতা, কেউ নেহাত অন্তঃপুরসঞ্চারী। কিন্তু প্রত্যেকের মধ্যেই তেজোদীপ্তি অনির্বাণ, তাই They Dared, কিছু-না-কিছু নতুন ভাবে শুরু করেছিলেন তাঁরা। থেমে থাকেননি, মেনে নেননি।
প্রীতিলতা ওয়াদ্দারের (বেথুন কলেজের নথিপত্র অনুসারে ওই কলেজের ছাত্রীটি নিজে এই বানানই লিখতেন) জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে পরিকল্পিত প্রবন্ধ সংকলনটিকে সম্পাদিকা সীমন্তী সেন দুই পর্বে বিন্যস্ত করেছেন। প্রথম পর্বে কয়েক জন উল্লেখযোগ্য বাঙালি নারীর কথা, এবং তাঁদের সূত্রে সে কাল থেকে এ কাল অবধি বাংলার নারী-ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকানো। দ্বিতীয় পর্বে, বাংলার বাইরের দুটি ভিন্ন জগতের নারীদের কথা ফরাসি বিপ্লবের বিদ্রোহী নারী এবং শোষণ-দমন-দ্রোহে দীর্ণ আধুনিক ইরানের নারীভুবনের বিশ্লেষণ। প্রথম পর্বের প্রতিটি কাহিনিই ব্যক্তিকেন্দ্রিক, ব্যক্তির মাইক্রোকজম-এর মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলা বহমান ইতিহাসের পরিবর্তনশীলতা। আলোচ্য বিষয় হয় এই নারীদের প্রকাশ্য দ্রোহজীবন, নয়তো তাঁদের রচনা বা কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে আসা বিদ্রোহপথ। আলোচ্য বিষয় যা-ই হোক না কেন, প্রতিপাদ্য বিষয় একটিই। তাঁদের নিজস্ব ‘বিশিষ্ট’ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা একটি ‘সামান্য’ সত্য: তাঁদের সময়ে তাঁদের পরিস্থিতিতে কোন্ ধরনের ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ করার কথা ভাবতে পেরেছিলেন এই বীরাঙ্গনারা, সাহসে ভর দিয়ে এগিয়ে যেতে পেরেছিলেন। এই দিক দিয়ে দেখলে উনিশশো-তিরিশের সশস্ত্র সংগ্রামী প্রীতিলতা ওয়াদ্দার কিংবা দু’ হাজার চার সালের দিল্লির গৃহ-পরিচারিকা বেবি হালদার, প্রত্যেকেই, জেনে কিংবা না-জেনে, এ দেশের নারী-সমাজে নতুন ধারার অগ্রদূত।
কেবল এইটুকুই নয়। আরও একটি জটিলতর প্রতিপাদ্য নিহিত থেকে যায় ছোট ছবি থেকে বড় ইতিহাসে পৌঁছনোর এই ধারাটির মধ্যে। প্রীতিলতা ওয়াদ্দার বিষয়ে সীমন্তী সেন, জ্ঞানদানন্দিনী বিষয়ে ঊর্মিতা রায়, নিরুপমা দেবীর রচনা নিয়ে অপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়, কিংবা উনিশ শতকের শেষ ভাগের বাঙালি অভিনেত্রীদের সম্পর্কে সুনেত্রা মিত্র যে কথা বলেন, সেই একই সুর ধরা পড়ে বাঙালি নৃত্যশিল্পীদের নিয়ে ঐশিকা চক্রবর্তীর প্রবন্ধে, কিংবা উত্তরা চক্রবর্তীর লেখা বীণা দাসের আলোচনায়। সেই সুরটি একটি ‘বিট্রেয়াল’-এর সুর, শেষ পর্যন্ত কিছুতেই পূর্ণ না-হতে-পারা প্রতিশ্রুতির সুর। |
সঙ্গের ছবি |
বীণা দাস |
প্রীতিলতা |
|
এঁদের প্রত্যেকেরই জীবন কিংবা জীবনের প্রধান কর্মকাণ্ড যেন ‘পলিটিকস অব বিট্রেয়াল’-এর অভিজ্ঞতায় নিষিক্ত। প্রীতিলতা সশস্ত্র বিদ্রোহে অংশ নিয়েও শেষ পর্যন্ত সেই চিরকালীন ‘স্যাক্রিফাইস’ বা আত্মবলিদানের আদর্শের বাইরে বেরোতে পারেননি। দূরদেশে ভ্রমণকালে শাড়ির পরার অন্তঃপুরীয় বিধির পাল্টানোর সাহস দেখিয়েছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী, কিন্তু নারীর পরিধানের অলঙ্ঘনীয় অনুষঙ্গ যে নারীদেহ-বিষয়ক ‘লজ্জা’, তার বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত হতে পারেননি তিনি বা তাঁর সমসাময়িক প্রগতিশীলারা। একই ভাবে, উনিশ শতকীয় নারীর সাহিত্য-রচনা কিংবা বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালি নারীর নৃত্যকল্পনা, দুই পরিসরেই স্পষ্ট যে বিপ্লব শুরু হল, খানিক দূর এগিয়ে তা যেন আবার নতুন করে সামাজিক শৃঙ্খলের গোলকধাঁধায় আবদ্ধ হয়ে পড়ল: নারীত্বের যে ধারণা শাখাপ্রশাখায় বিকশিত হয়ে শিকড় ছড়িয়ে গিয়েছিল নারীচেতনার মধ্যেই, তাকে পরিহার বা অতিক্রম করে যেতে পারল না। অনেক দিন আগে বিনোদিনী বিষয়ে পার্থ চট্টোপাধ্যায় একটি মন্তব্য করেছিলেন তাঁর নিজেরই ভাষায় nicely inconclusive মন্তব্য (নেশন অ্যান্ড ইটস ফ্র্যাগমেন্টস); তার অনুসরণে বলতে ইচ্ছে করে জাতীয়তাবাদ এক দিন মহা দর্পভরে যে সব সংকট দূর করে ফেলেছে বলে বড়াই করেছিল, বিনোদিনীর মতো (কিংবা জ্ঞানদানন্দিনী, নিরুপমা দেবী, প্রীতিলতার মতো) নারীরা মনে করিয়ে দেন, কিছুরই কোনও সমাধান হয়নি, সব সংকটই আবার নতুন রূপে প্রবাহিত হয়ে চলেছে মাত্র। তবু যে তাঁরা সমাধানের দিকে এক পা এগিয়েছিলেন, ‘অন্য’ ভাবে ভাবতে শুরু করেছিলেন, সেটাই উল্লেখযোগ্য।
যে ইতিহাস-চর্চার ধারা অনুসরণ করে এই লেখাগুলি তৈরি হয়েছে, তাকে যদি বুঝতে চাই, তবে দেখব অণু-ইতিহাসের মধ্য দিয়ে বড়-ইতিহাসের দিকে যাওয়ার সময়ে এখানে প্রচ্ছন্ন থেকে গিয়েছে একটি সতর্কতার মাত্রা। স্থান-কাল-ভাষার বিশিষ্টতার বেড়া ডিঙিয়ে যাতে এই ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ খুব বেশি বড় না হয়ে ওঠে, জাতীয়তাবাদ কিংবা উত্তর-আধুনিকতার ‘গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ’কে মুঠি-সমান বিশ্লেষণী পরিসরে ধরতে না চেয়ে যাতে কেবল ‘বাঙালি’ নারীভুবনের প্রতিসরণের রেখাগুলিই ঠিকঠাক ধরা যায় সেই সতর্কতা। এই সতর্ক সীমারেখার অনুচ্চারিত গণ্ডিটি বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়। ছোট থেকে বড়কে ধরার এই প্রয়াসকে যদি ইতিহাস চর্চার মানচিত্রে ফেলা যায়, তা হলে বলতে পারি লেখকদের লিখনভঙ্গি এবং বইটির সামগ্রিক উপস্থাপনার ধরনটি একেবারেই পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের আ প্রিন্সলি ইমপোস্টর-এর মতো নয়, বরং তনিকা সরকারের হিন্দু ওয়াইফ, হিন্দু নেশন-এর অনুবর্তী।
সংকলনের প্রথম পর্বের এই পরস্পর-গ্রথিত ধারাটির সঙ্গে দ্বিতীয় পর্বে এসে যুক্ত হয় সুভাষরঞ্জন চক্রবর্তীর ফরাসি বিপ্লবের নারী ও কিংশুক চ্যাটার্জির ইরানের নারীসমাজের বিশ্লেষণ। বিশ্লেষণের মাত্রাটি এখানে আলাদা রকমের। আর অণু-ইতিহাস নয়। বরং সামগ্রিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিত ও রাজনৈতিক অবস্থিতি থেকেই শুরু ফরাসি আর ইরানি নারীসমাজের পাঠ। বস্তুত এই দ্বিতীয় পর্ব অত্যন্ত মূল্যবান। পাঠকের কাছে স্থান ও কালের দিক থেকে একটি তুলনামূলক মানদণ্ড নিয়ে আসে এই দু’টি সুলিখিত প্রবন্ধ। বাঙালি নারীর রাজনৈতিক সক্রিয়তা দিয়েই এই বই শুরু হয়েছিল। তাই শেষ দিকে এসে বিদেশি নারীর রাজনৈতিক সচেতনতার এই ছবিগুলি আমাদের একটা বড় প্রেক্ষিতের সঙ্গে পরিচিত করে দেয়।
এই শেষ মন্তব্যের সূত্র ধরেই বলি, সংকলনটি পড়ার পর একটি অস্বস্তি কিন্তু থেকেই যায়। বইয়ের প্রথম পর্বে যে বাঙালিনীদের কথা পাই, তাঁদের বেছে নেওয়ার কারণটা ঠিক কী? কেবল নানা রকমের ছোট ছবি থেকে বড় ইতিহাস রচনার প্রয়াসের দিকে লক্ষ রেখেই কি এই সাহসিকাদের নির্বাচন? লড়াই-এর প্রেক্ষিত ভিন্ন হলে যে লড়াই-এর ভাব, ভাষা এবং প্রতিপক্ষও অনেকটা পাল্টে যায়, সেই সত্যটি কি গৌণ হয়ে গেল না এই নির্বাচনের সময়? রাজনীতি-ক্ষেত্রে প্রীতিলতা-বীণা দাসের সংগ্রামের সঙ্গে কানন দেবী কিংবা নিরুপমা দেবী কিংবা মঞ্জুশ্রী চাকী সরকার কিংবা বেবি হালদারের সংগ্রামের আলোচনা আমাদের এক দিক দিয়ে আলোকিত করে ঠিকই। কিন্তু আরও এক রকমের আলোর জন্য তবুও যে অনেকখানি তৃষ্ণা থেকে যায়। অনভ্যস্ত পেলব হাতে বন্দুক তুলে নিয়েছিলেন যে দুই অসমসাহসিকা বাঙালি মেয়ে, তাঁদের সূত্রে বাংলার বা ভারতের অন্যান্য রাজনৈতিক নারী-যাত্রার কথাও জানতে ইচ্ছে করে। বিশ শতকের প্রথমার্ধের পাশাপাশি বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের নারী-রাজনীতির কিছু ছবি পেতে ইচ্ছে করে। সেটা পেলে প্রীতিলতা ওয়াদ্দারের স্মৃতিবাহী সংকলনটি হয়তো রাজনীতি-ক্ষেত্রে মেয়েদের লড়াই-এর দিগ্দর্শনটি আর একটু স্পষ্ট করে তুলত। |
|
|
|
|
|