দক্ষিণ কলকাতা

কলোনি

নিয়ম-বেনিয়মের আড়ালে
পথে নিত্যযাত্রীর সংখ্যা কয়েক লক্ষ। কিন্তু সরাসরি যাতায়াতের কোনও বাস নেই। ফলে সোনারপুর পুর এবং গ্রামীণ এলাকা থেকে ধর্মতলা যাতায়াত করতে ভোগান্তির পাশাপাশি খরচও বেশি হয়। অথচ প্রতি দিন ওই সব এলাকা থেকে কয়েক লক্ষ যাত্রী ধর্মতলায় যাতায়াত করেন।
সোনারপুর থেকে এসডি-ফাইভ রুটের বাস সরাসরি তারাতলায় যায়।
ভূতল পরিবহণ নিগমের কিছু বাস কলকাতা স্টেশনে যায়। কিন্তু ধর্মতলায় যেতে হলে সোনারপুর এলাকার বাসিন্দারা অটোয় রাজপুর বা গড়িয়ায় এসে বাস কিংবা মেট্রো ব্যবহার করেন। কেউ কেউ আবার ট্রেনে শিয়ালদহ পৌঁছে, তার পরে বাসে ধর্মতলা যান।
দু’টি পাঁচতলা বাড়ির মধ্যে মাত্র তিন-চার ফুটের দূরত্ব। তুমুল বৃষ্টির মধ্যেও দু’টি বাড়ির মাঝখান দিয়ে এগোলে একফোঁটা জলও গায়ে লাগে না। দু’টি বাড়ির মধ্যে যে কোনও একটির দেওয়ালে মেরামতির দরকার হলেও জায়গার অভাবে রাজমিস্ত্রি ভারা বাঁধতে পারেন না।
অনেক ক্ষেত্রে বাড়ি তৈরির নকশা অনুমোদন করানো হলেও তা মেনে চলার পরোয়া নেই। বিল্ডিং আইনও মানা হয় না অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। জলের সংযোগ নেওয়ার অনুমোদন নেই। বাড়িঘর অত্যন্ত ঘেঁষাঘেঁষি করে তৈরি হওয়ায় পথচারী ও গাড়ি চলাচলের রাস্তা অত্যন্ত সরু।
এলাকায় আগুন লাগলে দমকলের গাড়ি ঢোকার জায়গা নেই। অনেক জায়গাতেই বেআইনি ভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ নেওয়া হয়েছে। নিকাশি ব্যবস্থার নামগন্ধ নেই, যে যেমন ভাবে পারে নর্দমা কেটে নোংরা জল রাস্তায় ফেলে দিচ্ছে। দক্ষিণ কলকাতার ১০ নম্বর বরোর ৩৪টি কলোনি সম্পর্কে বারে বারে এমন সব অভিযোগই উঠেছে।
দেশভাগের পরে ও পার বাংলায় সব হারিয়ে আসা মানুষজন অনেকেই এই সব এলাকায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। এ সব জমির কিছুটা ছিল সরকারি খাস জমি, কিছুটা অধিগৃহীত। প্রাক্তন ভূমি রাজস্বমন্ত্রী আবদুর রেজ্জাক মোল্লা জানান, এই এলাকার জমি এক সময় ভূমি দফতরের অধিকারে থাকলেও পরে হস্তান্তরিত হয় উদ্বাস্তু ত্রাণ ও পুনর্বাসন দফতরের হাতে। এখন কলোনিগুলির প্রায় সব জমির মালিকানাই বাসিন্দাদের হাতে তুলে দিয়েছে সরকার। কিন্তু মালিকানা হস্তান্তরের ভিতরে একটি শর্ত ছিল, ১০ বছর অবধি জমির অধিকার অন্য কারওকে দেওয়া যাবে না।
জানা গিয়েছে, অধিকাংশ জমিরই হস্তান্তরের পরে দশ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। ফলে এই সব এলাকায় বহুতল তৈরির ধুম পড়ে যায়। বরো চেয়ারম্যান তৃণমূলের তপন দাশগুপ্ত বলেন, “তিন, চার বা পাঁচ তলা বাড়ি তৈরির জন্য পুরসভার বিল্ডিং আইনের যে সব নিয়মবিধি আছে, তার কোনওটাই এ ক্ষেত্রে মানা হয়নি। এখনও মানা হচ্ছে না।” এই অঞ্চলের আজাদগড় কলোনি কমিটির সম্পাদক সুব্রত চৌধুরীর কথায়: “সব ক’টি কলোনিতে বহু বছর আগে থেকে এমন কথা চালু আছে যে, উদ্বাস্তুদের দেওয়া জমিতে বাড়ি তৈরি করলে বিল্ডিং আইন মানার দরকার নেই। কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ ভুল।
বস্তির জন্য ঠিকা আইন থাকলেও কলোনির জন্য সাধারণ বিল্ডিং আইনই প্রযোজ্য। যা না মানার জন্য প্রতিটি কলোনিতে হু হু করে প্রোমোটারেরা ঢুকে পড়েছেন। সার সার তিন-চার-পাঁচ তলা ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরি হয়ে যাচ্ছে।”
মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, “এ সমস্যা অনেক কালের। আগের সরকার বা পুরবোর্ড কিছুই করেনি। আমরা মানুষের মাথা গোঁজার জায়গাটুকু কেড়ে নিতে চাই না। মূল বিল্ডিং আইন কিছুটা শিথিল করে কী ভাবে কলোনি এলাকায় বাড়িঘর আইনসঙ্গত করা যায় তার চেষ্টা করছি।” ৯৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আরএসপি-র মহম্মদ সেতাবুদ্দিন বলেন, “আগুন লাগলে কী হবে বলতে পারব না। দমকলের গাড়ি তো দূরের কথা, মানুষ চলাচলেরই জায়গা নেই। একশো শতাংশ বাড়িরই কোনও প্ল্যান নেই। প্রোমোটারদের হাতে বন্দি হয়ে পড়েছে গোটা অঞ্চল।”
পুরসভার বিল্ডিং বিভাগের তেমন হেলদোল না থাকলেও আতঙ্কিত অন্যান্য পরিষেবা বিভাগের কর্তারা। পুরসভার বস্তি বিভাগের মেয়র পারিষদ অতীন ঘোষ বললেন, “কলোনিগুলোর পরিস্থিতি খুবই খারাপ, অস্বীকার করছি না। দীর্ঘ কাল ধরেই ওখানে বেআইনি বাড়িঘর তৈরি হচ্ছে। যদিও শহরের অন্য এলাকার মতো ওখানেও পুরসভার সাধারণ বিল্ডিং রুলই প্রযোজ্য। কিন্তু এ নিয়ে কেউই গা করেনি।”
গত পুরবোর্ডে বিল্ডিং বিভাগের মেয়র পারিষদ সিপিএমের দীপঙ্কর দে বর্তমানে ঢাকুরিয়ায় ৯১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। তিনি স্বীকার করলেন, “দেশভাগের পর উদ্বাস্তুদের সুবিধা দিতে তাঁদের জবরদখল করা জমিতে বাড়ি তৈরির ব্যাপারে কিছুটা সুবিধা দেওয়া হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু এত বছর ধরে তা চলা উচিত ছিল না। ভোটের চিন্তা এর অন্যতম প্রধান কারণ।”
এই এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ে সিইএসসি-র লস কন্ট্রোল বিভাগের এক কর্তা বলেন, “বহু বছর আগে একটি একচালা বাড়ির জন্য যে সংযোগ দেওয়া হয়েছিল, তার জায়গায় চার-পাঁচ তলা বাড়ি তৈরি হওয়ার পর পুরনো সংযোগ থেকেই লাইন টেনে নেওয়ার অজস্র ঘটনা ঘটে চলেছে। অগুন্তি অনুমোদনহীন এসি মেশিন থেকে আধুনিক বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতির অবাধ ব্যবহারে প্রবল চাপ পড়ছে সরবরাহের উপর। যখন-তখন লাইনে ফল্ট হচ্ছে।”
পুরসভার ডিজি (জল সরবরাহ) বিভাস মাইতির বক্তব্য, “ওই এলাকায় অস্বাভাবিক জনস্ফীতি সামাল দিতে রানিকুঠিতে বুস্টার পাম্প বসাতে হয়েছে।” কিন্তু জলের সংযোগ নেওয়ার জন্য কি পুরসভার কাছে আবেদন জমা পড়ে? সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক আধিকারিকের জবাব: “দশ হাজার বাড়ির মধ্যে একটা হয় কি না সন্দেহ।”
এ সব কলোনিতে তিন, চার ও পাঁচ তলা বাড়ির সংখ্যা কত? এখনও পর্যন্ত এই বরোয় বাড়ির সংখ্যা নির্ধারণে সমীক্ষা হয়নি বলে জানিয়েছেন বরো চেয়ারম্যান তপন দাশগুপ্ত। তিনি বরো অফিসের হিসেব উল্লেখ করে জানান, ২০০৭-এর ১ এপ্রিল থেকে ২৬ জুলাই অবধি গোটা বরোয় মাত্র ১৮১৩টি বাড়ির নকশা মঞ্জুর করা হয়েছে। ১১১টি নকশা বাতিল করা হলেও বাড়ি তৈরি অবশ্য বন্ধ হয়নি। তার সঙ্গে একই সময়ের মধ্যে আরও ৩৮৮টি এমন বাড়ির নকশা মঞ্জুর করা হয়, যেগুলি আগে কোনও অনুমোদন না-নিয়েই তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তবে, এই হিসেবটি কলোনি এলাকারই না কি সাধারণ এলাকার, তা অবশ্য বরো কর্তৃপক্ষ জানাতে পারেননি।
ঘিঞ্জি এলাকার বাড়িঘরের জন্য নির্মাণ প্রযুক্তির দিক থেকে কী বিপদ হতে পারে জানিয়েছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রাক্তন প্রধান নীতিন সোম। তিনি বলেন, “দু’টি বাড়ির মধ্যে পরিমাণ অনুযায়ী (ফ্লোর এরিয়া রেশিও) জায়গা রাখার প্রয়োজন শুধু পরিবেশ রক্ষার জন্যই নয়, দীর্ঘ কাল মাটির ভার বহনের ক্ষমতার প্রয়োজনেও দরকার। একটি পাঁচ তলা বাড়ি তৈরি হলে তার ভার যত দূর যেতে পারে, সেটি হিসেব করা হয়। তাকে বলে ‘ইনফ্লুয়েন্স জোন’। ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড সেই কারণেই তৈরি হয়েছে।”
রাজেন্দ্রপ্রসাদ কলোনির আদি বাসিন্দা রুদ্রাংশু দত্ত এখন কর্মসূত্রে ইতালিতে থাকেন। কিছু দিন রয়েছেন এখানে। তিনি বলেন, “প্রায় ২৮ বছর পরে বাড়ি ফিরলাম। কিন্তু পরিস্থিতি দেখছি ভয়ঙ্কর। যে কোনও দিন গোটা কলোনি এলাকা মাটির তলায় ঢুকে যেতে পারে। এত গায়ে গায়ে লাগানো চার-পাঁচ তলা বাড়ি তৈরি হয়ে গিয়েছে, ভাবতেই পারছি না।”

ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.