|
|
|
|
|
|
বঙ্গে বাণিজ্য |
হাট থেকে ব্র্যান্ড
গৌতম বসুমল্লিক |
|
|
আজ থেকে ১৮২ বছর আগে (ওয়েবসাইট জানাচ্ছে, প্রতিষ্ঠা ১৮৩০-এ) পাথুরিয়াঘাটার হাটে মিষ্টি বিক্রি করতেন বর্ধমান-খণ্ডঘোষের দুবরাজহাট গ্রাম থেকে আসা ময়রা রামচন্দ্র দাস। পাঁচ প্রজন্ম পেরিয়ে রাম-ময়রার সেই দোকান আজ কলকাতার অন্যতম সন্দেশ-বিক্রেতা ‘মাখনলাল দাস অ্যান্ড সন্স’।
সাবেক চিৎপুর রোডের উপরে এখন যেখানে ‘নতুন বাজার’, সেই অঞ্চলেই সোমবার আর বৃহস্পতিবারে বসত হাট। সেই দু’দিন হাটতলার কুঁড়েতে আর সপ্তাহের অন্য দিনে এলাকায় ঘুরে ঘুরে মিষ্টি বিক্রি করতেন রামচন্দ্র। সে যুগের রীতি অনুসারে ময়রার নামেই চলত দোকান। পুত্র মাধবচন্দ্র বাবার মতোই মিষ্টি বেচতেন ওই হাটে। তিনি ছিলেন স্বল্পায়ু। অবস্থার পরিবর্তন হল মাধবচন্দ্রের ছেলে মাখনলালের সময় থেকে। |
|
অল্প বয়সে পিতৃহীন হওয়ায় দোকানের ভার পড়ল সিপাই বিদ্রোহের বছর তিনেক আগে জন্মানো মাখনলালের হাতে। এখন দোকানের অন্যতম মালিক স্বপন দাস জানালেন, মাখনলাল প্রথমেই নজর দিলেন মিষ্টির গুণমানের দিকে। বাংলার মিষ্টান্নশিল্পের আদি পর্বে ছিল চিনি থেকে তৈরি নবাত, বাতাসা, কদমা, তিলুয়া, মণ্ডা জাতীয় মিষ্টি আর ঘিয়ে ভাজা পান্তুয়া জাতীয় মিষ্টি। দ্বিতীয় রকমের মিষ্টি দেবসেবায় নিষিদ্ধ ছিল। তাই ময়রারা যে কোনও এক রকমের মিষ্টি তৈরি করতেন। পিতৃপুরুষের ধারা মেনে মাখনলাল মণ্ডা জাতীয় মিষ্টি তৈরিতেই জোর দিলেন। ইতিমধ্যে বাংলার মিষ্টান্নশিল্পে আবির্ভূত হয়ে গিয়েছে ‘সন্দেশ’ নামে এক প্রকার মিষ্টি। দুধ কাটিয়ে তার থেকে ছানা বের করে, সেই ছানার সঙ্গে চিনি মিশিয়ে কড়ায় পাক দিয়ে তৈরি করা হত সেই সন্দেশ। মাখনলাল মণ্ডা জাতীয় মিষ্টির পাশাপাশি সন্দেশ তৈরিতেও মন দিলেন। পাশাপাশি ‘ব্র্যান্ডিং’-এর শর্ত মেনে নিজের নামানুসারে দোকানের নামকরণ করলেন ‘মাখনলাল দাস’। চিৎপুর নতুন বাজারের ভিতরের সেই দোকানের বর্তমান ঠিকানা ৩১৩ রবীন্দ্র সরণি।
রামচন্দ্র দাস ময়রার মিষ্টির দোকান যখন ‘মাখনলাল দাস’ ব্র্যান্ড-নামে পরিচিত হতে চলেছে, বাংলার মিষ্টান্নশিল্পের তখন জোয়ার। কাছাকাছি সময়ের মধ্যেই কলকাতার বাজারে এসে গিয়েছেন নবীনচন্দ্র দাস, দ্বারিকচন্দ্র ঘোষ, ভীমচন্দ্র নাগ, গিরিশচন্দ্র দে-র মতো ময়রা-মোদকেরা। এঁরা শুধু মিষ্টির কারিগর বা বিক্রেতা ছিলেন না, ছিলেন মিষ্টান্ন-গবেষক। জমিদার আর বেনিয়ান শ্রেণির কল্যাণে কলকাতা তখন ভাসছে ‘বাবু কালচার’-এর জোয়ারে। নব্য-বাবুদের রসনার পরিতৃপ্তি ঘটাতে ময়রার পাকশালাতেও চলছে হরেক গবেষণা। ফুটন্ত চিনির রসে ছানার গোলা ফেলে যে ‘রসগোল্লা’ তৈরি করেছিলেন রানাঘাটের এক ময়রা তাকেই আরও পরিশীলিত করে ‘স্পঞ্জ রসগোল্লা’য় উন্নীত করলেন বাগবাজারের নবীন ময়রা। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের প্রিয় কড়াপাক সন্দেশের পাকে রকমফের ঘটিয়ে ভীমচন্দ্র নাগ তৈরি করলেন ‘আশুভোগ’ সন্দেশ। মাখনলালও মন দিলেন সন্দেশের মান উন্নয়নে।
প্রাণীদেহ থেকে উৎপন্ন বলে এক সময় গোরুর দুধ কাটানো ছানা দিয়ে তৈরি মিষ্টান্ন দেবতাকে দেওয়া যেত না। কালক্রমে সে বাধা উঠে গেলে রসগোল্লা-সন্দেশ দেবভোগ্য হয়ে উঠল। এখনও মাখনলাল দাসের দোকানে পুজোর জন্য এক টাকা, দু’টাকা দামের সন্দেশ পাওয়া যায়। মাখনলালের দোকানে এখন পাওয়া যায় কড়া ও নরম পাকের ‘জলভরা’, ‘মনোহরা’, ‘দেলখোস’ ‘চকোলেট তালশাঁস’, ‘পেস্তা সন্দেশ’। দূরত্ব অনুযায়ী ভাড়ার বিনিময়ে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থাও আছে।
মাখনলাল ছিলেন দীর্ঘজীবী। ১৯৪৬-এ তিনি ৯৩ বছর বয়সে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পরে পুত্র এবং পৌত্রদের হাত ঘুরে ব্যবসা এখন প্রপৌত্রদের হাতে। তাঁর এক প্রপৌত্র স্বপন দাস বলেন, ‘‘দাদু-বাবাদের কাছে শুনেছি, মাখনলাল মিষ্টির গুণমানের উপরে খুব জোর দিতেন। আমরাও সেটাকে গুরুত্ব দিই। মানিকতলা, বাগবাজার, বিধাননগরে আমাদের সেল্স-কাউন্টার থাকলেও সমস্ত মিষ্টি তৈরি হয় এখানে, আমাদের সামনে।’’ |
|
|
|
|
|