প্রতি পক্ষ

স্বাধীনতা, কিন্তু...
তিনি ‘পিপলি লাইভ’ দেখেননি। ‘পিপলি লাইভ’ নামে কোনও ছবি আছে তাও জানেন কি না সন্দেহ। সুতরাং, তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গেলে ‘পিপলি লাইভ’-এর প্রসঙ্গ তোলার কোনও অর্থ নেই, এক দিকে।
অন্য দিকে, তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময় মনের কোণে ‘পিপলি লাইভ’-এর একটা ছায়া থাকতে বাধ্য। কারণ, সেই যে বিচিত্র এক গ্রাম, পিপলি, সে তো আসলে ‘মিনি ভারত’। ঝকঝকে ‘ইন্ডিয়া’ নয়, বিবর্ণ ভারত। শহুরে লোকেরা যাদের প্রায়শ নাসিকা কুঞ্চিত করে বলেন, ‘অজ গাঁ’, ধরা যাক, সেই সব পরিসরে গিয়ে পড়ল, উঁহু, মিডিয়া নয়, ম্যানেজমেন্ট পাশ করা কিছু ছেলেমেয়ে। কিছু উদ্যোগী।
বলুন, সামাজিক উদ্যোগী। সোশ্যাল এন্টারপ্রেনর, হাসলেন আমিয়াজ এ মলেডিনা। আমেরিকার উস্টার কলেজের অর্থনীতির শিক্ষক, এবং সেই কলেজে ‘সোশ্যাল এন্টারপ্রেনরশিপ’, বাংলা পরিভাষায় ‘সামাজিক উদ্যোগ’ কর্মকাণ্ডের পুরোধা। তিনি কলকাতায় হাজির, এবং সেই সূত্রেই তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ।
আমিয়াজ এ মলেডিনা
সামাজিক উদ্যোগ বস্তুটি কী, তা নিয়ে অনেকেরই ধারণা খুব স্বচ্ছ নয়। এ কি দান-খয়রাতি? লাগে টাকা দেবেন যিনি, তাঁরই নাম ‘সামাজিক উদ্যোগী’!
মলেডিনা সপ্রতিভ ভঙ্গিতে বললেন, সমস্যা কম নয়। শহরে এক রকম, শহর ছাড়িয়ে গ্রামাঞ্চলে অন্য রকম। আমি বলব, ‘সামাজিক উদ্যোগ’ সে সবের সঙ্গে মোকাবিলার একটা রাস্তা। ধরুন, দারিদ্র। বেশ কিছু জায়গায় এমন কিছু দারিদ্রের সমস্যা আছে, সরকার সে ভাবে যার মোকাবিলা করতে পারে না, বাজারও হয় পারে না বা ততটা উৎসাহ দেখায় না, ‘সামাজিক উদ্যোগ’ সে সব সঙ্কটের এক ধরনের সমাধান করতে পারে। পেরেওছে। আবার, শুধু যে কোনও একটি দেশের মধ্যেই এই জাতীয় উদ্যোগ আটকে থাকে, তা-ও নয়। অনেক সময়েই দেখা যায়, ‘সামাজিক উদ্যোগ’ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বড় গণ্ডিতে ছড়িয়ে গিয়েছে।
পরের প্রশ্নটা যথেষ্ট প্রত্যাশিত। লাভ-লোকসানের অঙ্ক। সাধারণ বাণিজ্যিক উদ্যোগ তাৎক্ষণিক লাভ চায়। দীর্ঘমেয়াদী লাভ-টাভ নিয়ে তার তত মাথাব্যথা নেই। শুনে মনে হয়, ‘সামাজিক উদ্যোগ’ তার উল্টো। স্বল্পস্থায়ী লাভলোকসান নিয়ে তার চিন্তা নেই। বরং, অনেকটা বড় পরিসরে জনতার দীর্ঘমেয়াদি লাভ হলেই হল!
ঠিক, ‘সামাজিক উদ্যোগ’-এর একটা ‘ফোকাস’ আছে। ফোকাসটা কী, সবাই জানেন। সামাজিক স্তরে পরিবর্তন। তাতে সময় একটু বেশি লাগারই কথা, লাগেও। আর, সেই সামাজিক পরিবর্তনটাও যে খুব ছোট মাপে চাওয়া হয়, এমনও নয়। বরং, বেশ ছড়ানো একটা পরিসরে, যাকে ‘ব্রড-বেসড চেঞ্জ’ বলে, জিনিসটা সে রকম।
সে তো অনেক কালের কাজ। তাড়াতাড়ি হওয়ার নয়।
হয়ও না। মোটেই হয় না। যথেষ্ট সময় লাগে। খুব কুশলী পরিকল্পনা লাগে। অধ্যবসায় লাগে, দাঁতে দাঁত চেপে পড়ে থাকতে হয়। ধৈর্য ধরতে হয়। কাজটা চলতে চলতে ‘সামাজিক উদ্যোগ’-এর মধ্যেও নানা রকম পরিবর্তন আসে। আমি এই ধরনের যত কর্মকাণ্ড দেখেছি, তার অধিকাংশই ছোট মাপে শুরু হয়েছিল। কাজটা করতে করতে তারা নানা কিছু শিখেছে, লক্ষ্যটা বড় হয়েছে। তবে, একটা ভুল কিন্তু অনেকেই করেন। দয়া করে সেই বিষয়ে একটু সজাগ থাকবেন।
কী ভুল?
ভুলটা এই যে, অমুক কাজটা সামাজিক উদ্যোগ, আর তমুকটা নেহাতই বাণিজ্যিক উদ্যোগ, এই ধাঁচটা কিন্তু একেবারে খুব সাধারণ একটা প্রক্রিয়া। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়। শুধু ‘সামাজিক উদ্যোগ’ বা শুধু ‘বাণিজ্যিক উদ্যোগ’, এই জাতীয় ভাগাভাগির মধ্যে একে আটকে রাখা যায় না। সম্ভবও নয়। একটু সহজ করে জিজ্ঞেস করি। ‘সামাজিক উদ্যোগ’ কি লাভের আশা করে না? একদম বাণিজ্যিক অর্থে লাভের কথা বলছি। ‘সামাজিক’ লাভ তো আছেই, কিন্তু যাকে লাভের কড়ি বলে, ‘সামাজিক উদ্যোগ’ তো সেটাও চায়!
চায়। ঠিক ততটুকুই চায় যাতে তাদের কাজটা চলতে পারে, যাতে কর্মীদের এমন একটা টাকা দেওয়া যায়, যে টাকাটা পেলে তাদের কাজ করার ইচ্ছেটা থাকবে, তারা অন্য কোথাও চলে যাবে না। তা ছাড়া, ‘স্কেলিং’ বলে একটা কথা আছে, কাজের পরিধিটা ক্রমশ ছড়িয়ে দেওয়া, সেটা করার জন্যেও তো টাকাপয়সা দরকার। সেটাও মাথায় থাকে নিশ্চয়ই।
‘পিপলি লাইভ’-এর একটি দৃশ্য
ধরুন, ম্যানেজমেন্ট পাশ-টাশ করা ছেলেমেয়েরা এমন একটা জায়গায় গিয়ে পড়ল, একেবারে গণ্ডগ্রাম, যে জায়গাটার সম্পর্কে তাদের কোনও ধারণাই নেই। সেখানকার লোকেরা কী পরে, কী খায়, কী ভাবে থাকে, সে সব তারা জানেই না। তো, ‘সামাজিক উদ্যোগী’রা সেখানে কী ভাবে এগোবেন?
যেমন?
ধরুন, একটা ঘটনা। কোনও একটি প্রত্যন্ত গ্রামে লোকজনদের ধোঁয়াহীন উনুন দেওয়া হল। তো, লোকেরা সে সব নিলই না।
কেন? ‘সামাজিক উদ্যোগী’রা অবাক। দেখা গেল, লোকেরা উনুনের ধোঁয়াটাই চায়, তাতে ঘরের খড়ের চালে থাকা পোকামাকড়ের উপদ্রব কমে।
দেখুন, এটা তো ঠিকই যে, আমার ধারণা নিয়ে আমি কোনও গ্রামে যেতে পারি, কিন্তু সেখানে গিয়ে তো আমাকে সেখানকার জমিটা, বাস্তব অবস্থাটা বুঝতে হবে। দেখতে হবে, কোথায় কাজটা হচ্ছে, কী নিয়ে কাজ হচ্ছে, ঠিক কী ধরনের লোকজন সেই কাজকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে, কী ভাবে জড়িয়ে তার পরে আসবে কাজটা করার প্রশ্ন। কী ভাবে কাজটা করব, কী হওয়া উচিত, কী অনুচিত, কী ভাবে ওই সব লোকজনকে তাদের কাজে জড়িয়ে নেওয়া যায়, এই সব! আমি মনে করি না, কোনও একটা নিদান হেঁকে বলা যাবে যে, অমুক কাজটা তমুক ভাবেই করতে হবে, অন্য কোনও ভাবে নয়। বিভিন্ন রকম উদ্যোগ। তাদের কাজকর্মও নানা রকম। উপদেশের ভঙ্গিতে কয়েকটা ‘মডেল’ খাড়া করে বললাম, ইহাই সত্য, ব্যস, এটা সম্ভব নয় বলেই আমার ধারণা। উচিতও নয়।
শেষ প্রশ্নে আসি। এখনও পর্যন্ত ‘সামাজিক উদ্যোগ’ কোথায় বেশ সফল বলে আপনি মনে করেন?
ধরুন, ‘ক’ বলে একটা সমস্যা, তার সমাধান দরকার। তাতে ‘খ’, ‘গ’, ‘ঘ’-রা জড়িয়ে। আবার, সরকারও আছে। এ বার একই টেবিলে ‘খ’, ‘গ’, ‘ঘ’ এলেন, সরকারের লোকও থাকলেন। একটা আলোচনা শুরু হল। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এই কাজটা ‘সামাজিক উদ্যোগ’ খুব ভাল করতে পারে। সমস্যায় আছেন যাঁরা, এবং সেই সমস্যার সমাধান করতে পারেন যাঁরা, দু’তরফই এক জায়গায় এলেন। কথাবার্তা চালাচালি হল। এই ভাবে, সমাধানের একটা বন্দোবস্ত হল, বা অন্তত সে দিকে এগোনোর একটা দিশা পাওয়া গেল। এটা খুব জরুরি।
কথা ফুরোল। কিন্তু মন জুড়ে থাকল পিপলি। কিংবা শুধু গ্রামই কেন? ধরা যাক, কলকাতা। ঝকঝকে উন্নয়নের বাইরে ঝাপসা কিছু এলাকা।
সেখানে স্বাধীনতা দিবসের পতাকা উড়েছে। কিন্তু... এই ‘কিন্তু’টা আছে বলেই সামাজিক উদ্যোগ জরুরি। হাসলেন আমিয়াজ এ মলেডিনা।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.