টু-জি কাণ্ডের দাগ মোছেনি, কয়লা এসে হাজির! বিমানবন্দর, বিদ্যুৎ প্রকল্প ও কয়লা ব্লক বণ্টন নিয়ে ফের কেলেঙ্কারির ভূত সওয়ার মনমোহন সরকারের কাঁধে! কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটরস জেনারেলের (সিএজি) অভিযোগ, ইউপিএ জমানায় কয়লা ব্লক বণ্টনে কেন্দ্র নিলাম না করায় সরকারি কোষাগারের ক্ষতি হয়েছে ১ লক্ষ ৮৬ হাজার কোটি টাকা। স্পষ্টতই যে ক্ষতির পরিমাণ টু জি স্পেকট্রাম বণ্টনে আর্থিক ক্ষতির থেকেও বেশি। পাশাপাশি দিল্লি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আধুনিকীকরণ এবং বিদ্যুৎ প্রকল্পে বেসরকারি সংস্থাকে বহু কোটি টাকার অতিরিক্ত সুবিধা পাইয়ে দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সিএজি। এ ব্যাপারে তিনটি আলাদা রিপোর্ট আজ সংসদে পেশ হয়েছে। সব মিলিয়ে বেসরকারি সংস্থাগুলিকে বেআইনি ভাবে ৩ লক্ষ ৮০ হাজার কোটি টাকার সুবিধা ‘পাইয়ে দেওয়া’ হয়েছে।
কয়লা ব্লক বণ্টনে কেলেঙ্কারির অভিযোগ এনে অনেক আগে থেকেই সরব ছিল বিরোধীরা। তার জবাব প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সচিবালয়ের তরফে ইতিমধ্যে দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ-ও মাস দুয়েক আগে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তা সত্ত্বেও সিএজি রিপোর্টে আর্থিক ক্ষতির যে পরিমাণ তুলে ধরা হয়েছে তা বিরোধীদের অক্সিজেন দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। বিশেষ করে লোকসভা ভোটের যখন আর দেড় বছরও বাকি নেই। তাই স্বাধীন ভারতে এ যাবৎ ‘সর্ববৃহৎ আর্থিক কেলেঙ্কারির’ তকমা সেঁটে কেন্দ্র-বিরোধিতায় নেমে পড়তে বিজেপি আজ দেরি করেনি।
কেন্দ্রে ইউপিএ সরকারের আট বছরের মধ্যে পাঁচ বছর প্রধানমন্ত্রীর অধীনেই কয়লা মন্ত্রক ছিল। তাই মনমোহন সিংহকেই সরাসরি নিশানা করেছেন বিজেপি নেতৃত্ব। আর্থিক ক্ষতির নৈতিক দায় নিয়ে মনমোহনের ইস্তফা দেওয়া উচিত বলে দাবি জানিয়েছেন সুষমা স্বরাজ-অরুণ জেটলিরা। তাঁরা মনে করছেন, ইউপিএ যে ভাবে পরতে পরতে দুর্নীতির অভিযোগে জড়িয়ে পড়ছে, তাতে স্রেফ এই এক অস্ত্রেই আগামী লোকসভা ভোটে বধ করা যাবে কংগ্রেসকে। প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে তর্জনী তুলেছেন বামেরাও। সিপিআই নেতা গুরুদাস দাশগুপ্তের কথায়, “ইউপিএ-র দুর্নীতির মহাকাব্যে মনমোহন হলেন ধৃতরাষ্ট্র।”
ভাবমূর্তি নিয়ে উদ্বিগ্ন কংগ্রেসও। স্পেকট্রাম হোক বা কয়লা ব্লক, তা বণ্টনের ব্যাপারে সরকারের নীতির সপক্ষে কংগ্রেসের যুক্তি কম নেই। কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্বও বুঝতে পারছেন, সেই যুক্তি আম আদমিকে বোঝানো কঠিন। বরং বিজেপি সহজে বলে দিতে পারবে, কংগ্রেস স্পেকট্রাম কাণ্ডে ১ লক্ষ ৭৫ হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারি করেছিল। আর কয়লা ব্লক বণ্টনে কেলেঙ্কারির অভিযোগ তার থেকেও বড়।
এই অবস্থায় কংগ্রেসের কাছে স্বস্তির বিষয় একটাই। তা হল যে সময়সীমায় কয়লা ব্লক বণ্টন নিয়ে অভিযোগ উঠছে তখন কয়লা মন্ত্রক মনমোহনের অধীনে ছিল। ব্যক্তিগত ভাবে যাঁর সততা প্রশ্নাতীত। তাই এ ব্যাপারে সংসদে প্রধানমন্ত্রী নিজে বিবৃতি দিতে পারেন। যে বিবৃতির মধ্যে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী সব রকম তদন্তের আশ্বাস তো দেবেনই, সেই সঙ্গে জানাবেন, তাঁর বিরুদ্ধে বিন্দুমাত্র দুর্নীতি প্রমাণ করে দেখাতে পারলে তিনি রাজনীতি থেকে সন্ন্যাস নেবেন। পাশাপাশি আজ প্রথমে সাংবিধানিক সংস্থাকেই আক্রমণ করেছে কংগ্রেস। তাঁদের বক্তব্য, সিএজি-এর হিসেবের পদ্ধতি ভুল, তারা এক্তিয়ারের সীমা ছাড়িয়েছে। তা ছাড়া কয়লা ব্লক বণ্টনের নীতি ভ্রান্ত ছিল না। একে তো বিজেপি ও বাম শাসিত রাজ্যের চাপ ছিল, তার উপর জনস্বার্থে ওই নীতি নিয়েছিল সরকার।
সিএজি রিপোর্ট অনুযায়ী, কেন্দ্রে প্রথম ইউপিএ সরকার পত্তনের এক মাস কাটতে না কাটতেই ২০০৪ সালের ২৮ জুন কেন্দ্র সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, নিলামের মাধ্যমে বেসরকারি সংস্থাকে কয়লা ব্লক বণ্টন করা হবে। তখন কয়লা মন্ত্রী ছিলেন শিবু সোরেন। কিন্তু শিবু জুলাই মাসেই ইস্তফা দেন। তার পর থেকে কয়লা মন্ত্রক প্রধানমন্ত্রীর অধীনে ছিল। সিএজি-এর বক্তব্য, নিলামের মাধ্যমে কয়লা ব্লক বণ্টনের ব্যাপারে প্রথম বাধা আসে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের তরফে। ২০০৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের তরফে বলা হয়, ব্লক নিলাম করার অনেক অসুবিধা। পরে আবার আইন মন্ত্রক বলে, নিলামের মাধ্যমেই কয়লা ব্লক বণ্টন করতে হলে আইন সংশোধন জরুরি। কিন্তু সেই আইন সংশোধনের জন্য খসড়া বিল প্রস্তুত করতে চার বছর নেয় কেন্দ্র। বিল পাশ হয় ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে। তাৎপর্যপূর্ণ হল, বিল পাশ হওয়ার পরে বিজ্ঞপ্তি জারি করতে কেন্দ্র আরও দেড় বছর নেয়। এই আট বছরের মধ্যে ১৪২টি কয়লা ব্লক বণ্টন করে কেন্দ্র। এর মধ্যে ৬৭টি কয়লা ব্লক বণ্টন করা হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে। বাকি ৭৫টি ব্লক বেসরকারি সংস্থাকে দেওয়া হয়েছে। রিপোর্ট অনুযায়ী, বেসরকারি সংস্থাগুলিকে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার তুলনায় টন প্রতি ২৯৫ টাকা কম দামে প্রায় ৪৪০০ কোটি টন কয়লা তোলার অধিকার দেওয়া হয়। তাতে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। কয়লা মন্ত্রকের সচিবের নোট উদ্ধৃত করে সিএজি-এর বক্তব্য, প্রধানমন্ত্রীকে সম্ভাব্য আর্থিক ক্ষতির ব্যাপারে অবহিতও করা হয়েছিল।
নিলামের নীতি রূপায়ণে বিলম্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিজেপি-ও। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের প্রতিমন্ত্রী ভি নারায়ণস্বামী এবং কেন্দ্রীয় কয়লা মন্ত্রী শ্রীপ্রকাশ জয়সওয়াল আজ বলেন, যে বিজেপি ও বামেরা নিলামের পক্ষে সওয়াল করছে, তাদের শাসিত রাজ্য ছত্তীসগঢ়, রাজস্থান ও পশ্চিমবঙ্গ সেই নীতির বিরোধিতা করেছিল। প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখে এই তিন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় রাজ্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। স্ক্রিনিং কমিটির মাধ্যমে কয়লা ব্লক বণ্টনের প্রচলিত ব্যবস্থাই রাখা হোক। সরকারের এক শীর্ষ নেতার কথায়, এর পর সিএজি জল নিলামের কথা বললেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। বাজারে বোতল বন্দি এক লিটার জলের দাম ১০ টাকা। আবার শিল্পের প্রয়োজনে বেসরকারি সংস্থা যে জল ব্যবহার করে তার জন্য সরকারকে মাসুল দেয়। কিন্তু সিএজি বলতেই পারে যে, বেসরকারি সংস্থার কাছ থেকে লিটার প্রতি দশ টাকা দাম আদায় করতে হবে। সরকার তা না করলে ফের কয়েক লক্ষ কোটি টাকার কেলেঙ্কারির রিপোর্ট দেবে।
পাশাপাশি অনিল অম্বানীর রিলায়্যান্স পাওয়ার সংস্থাকে বণ্টন করা কয়লা ব্লক থেকে উদ্বৃত্ত কয়লা তাদেরই অন্য একটি প্রকল্পে ব্যবহার করতে দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তেরও সমালোচনা করা হয়েছে রিপোর্টে। মধ্যপ্রদেশের সাসানে চার হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন একটি ‘আল্ট্রা মেগা’ বিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে তুলছে এই সংস্থা। সে জন্য প্রথমে কয়লার দুটি ব্লক বণ্টন করা হয় এই সংস্থাটিকে। পরে আরও একটি কয়লা ব্লক তাদের বণ্টন করা হয়। রিলায়্যান্স এর পর জানায় তাদের কাছে উদ্বৃত্ত কয়লা রয়েছে। তা বিবেচনা করার পর চিত্রাঙ্গীতে রিলায়্যান্সের অন্য একটি বিদ্যুৎ প্রকল্পে সেই উদ্বৃত্ত কয়লা চুক্তি বহির্ভূত ভাবে ব্যবহারের অনুমতি দেয় কেন্দ্র। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ হল, সাসানের থেকে বেশি দামে চিত্রাঙ্গী প্রকল্প থেকে বিদ্যুৎ বিক্রি করবে রিলায়্যান্স। সিএজি-র বক্তব্য, যার অর্থ রিলায়্যান্সকে ২৯ হাজার কোটি টাকার সুবিধা পাইয়ে দিয়েছে সরকার। অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে রিলায়্যান্স পাওয়ারের বক্তব্য, চুক্তি অনুসারেই বাড়তি কয়লা ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
আবার দিল্লি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে বেসরকারি সংস্থা জিএমআর-কে অতিরিক্ত সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ করা হয়েছে রিপোর্টে। এনসিপি-র প্রফুল্ল পটেল মন্ত্রী থাকাকালীন ওই সংস্থাকে বরাত দেওয়া হয়েছিল। সিএজি-এর বক্তব্য, চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে কেন্দ্রীয় বিমানমন্ত্রক জিএম আর-কে যাত্রীদের থেকে উন্নয়ন ফি আদায় করার অধিকার দিয়েছে। এর ফলে জিএমআর-কে ৩৪১৫ কোটি টাকা বাড়তি আয়ের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পাশের জমি জিএমআর-কে বছরে মাত্র ১০০ টাকার বিনিময়ে ৬০ বছরের জন্য লিজ দেওয়া হয়েছে। যে জমি ব্যবহার করে জিএমআর ৬০ বছরে অন্তত ১ লক্ষ ৬৩ হাজার কোটি টাকা আয় করতে পারে। তবে বিমান পরিবহণ মন্ত্রক, সিএজি-এর হিসেবের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
|
সিএজি-র অভিযোগ |
কয়লা ব্লক বণ্টন |
• নিলাম না করে স্রেফ সুপারিশের ভিত্তিতে ১৪২টি কয়লার ব্লক বিভিন্ন সংস্থাকে
• আইন ও কয়লা মন্ত্রকের সচিবের পরামর্শ শোনা হয়নি
• সরকারের ক্ষতি ১.৮৬ লক্ষ কোটি |
|
দিল্লি বিমানবন্দর |
• অনেক কম দামে এমজিআর সংস্থাকে বিমানবন্দর সংলগ্ন জমি
• বিমানবন্দর উন্নয়ন ফি বেআইনি ভাবে চাপিয়েছে সংস্থাটি
• এই সংস্থাকে বরাত দেওয়ায় ক্ষতি ৩৭৫০ কোটি |
|
বিদ্যুৎ প্রকল্পে সুবিধা |
• সাসান বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য ৩টি কয়লা ব্লক রিলায়্যান্স পাওয়ারকে।
• সংস্থা সেখানকার অতিরিক্ত কয়লা চিত্রাঙ্গী বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহার করে। অতিরিক্ত কয়লা এ ভাবে ব্যবহারের অনুমতি নিয়ে প্রশ্ন।
• সংস্থার লাভ ২৯ হাজার ৩৩ কোটি |
|
|