টানা তিন বার অসমের গদি দখল করে দিল্লির শীলা দীক্ষিত, হরিয়ানার ভূপিন্দরসিংহ হুদা, অন্ধ্রের প্রয়াত ওয়াই এস রাজশেখর রেড্ডির মতো কংগ্রেসের ‘হেভিওয়েট’ মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে এক সারিতে স্থান পেয়েছিলেন তরুণ গগৈ। কিন্তু আজ তাঁর রাজ্য থেকেই শুরু হওয়া সমস্যার জেরে সংসদে প্রশ্নের মুখে পড়ছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। প্রধানমন্ত্রী, সনিয়া গাঁধী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের পরেও অসমে গোষ্ঠীসংঘর্ষ ও হিংসা বারবার ফিরে আসায় অস্বস্তিতে পড়েছেন কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব। কেন্দ্রের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি শুধু নয়, অসমে বিবদমান দুই পক্ষও অভিযোগের আঙুল তুলছে অসমের শাসক দলেরই দিকে। সংসদ থেকে শুরু করে একেবারের স্থানীয় স্তরে, সর্বত্রই অভিযোগ পাল্টা অভিযোগের চাপানউতোর। যা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির ছকই বারবার দুর্গতিতে ফেলছে অসম-সহ উত্তর পূর্বের লক্ষ লক্ষ মানুষকে। এ বারের অশান্তিও তার ব্যতিক্রম নয়।
আগেও জমি দখল ও কর্মসংস্থানের সুযোগ নিয়ে অসমের বড়োভূমিতে গোষ্ঠীসংঘর্ষ হয়েছে। আবার মিটেও গিয়েছে। কিন্তু এ বার তা থামতেই চাইছে না। ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নেওয়া মানুষ ঘরে ফেরার মুখেই ফের আক্রমণ শুরু হচ্ছে। আজ ফের কোকরাঝাড়ে হাসিম আলি নামে এক ব্যক্তি গুলিতে নিহত হয়েছেন। গত কালও এমন সংঘর্ষে ২১ জন আহত হন। অসম থেকে দক্ষিণ ভারতে এসএমএসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে হুমকি, গুজব ও মিথ্যে প্রচার। এমনিতেই অসমের যে কোনও সমস্যার জন্য বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকে দায়ী করার মতো অতিসরলীকরণের ঝোঁক রয়েছে বিশেষ কিছু রাজনৈতিক দলের। রাজনীতির এই সব কারবারিরা নিজেদের স্বার্থেই মানুষকে ভুলিয়ে দেন যে একশো বছর আগে, ব্রিটিশ আমলেই হিন্দু ও মুসলমান বাঙালিরা অসমে থাকতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু এ বারের গোষ্ঠীসংঘর্ষের পিছনে আরও বড় রাজনৈতিক চক্রান্ত চলছে বলেও মনে করা হচ্ছে। সংখ্যালঘু ও বড়ো, দুই ছাত্র সংগঠনই অভিযোগ তুলছে, বারবার হিংসা উস্কে দেওয়ার পিছনে রাজ্যের শাসক দল, কংগ্রেসের অন্দরের টানাপোড়েনও দায়ী হতে পারে। মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈর ঘনিষ্ঠ মহলেরও দাবি, পরিকল্পিত ভাবে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার চেষ্টা চলছে।
দায় এড়াতে পারছেন না গগৈ নিজেও। তাঁর ঘোষিত সময়সীমা ১৫ অগস্ট পার হয়ে গেলেও, ধুবুরির ১৩৩টি ত্রাণ শিবিরে আশ্রিত প্রায় দেড় লক্ষ মানুষ ঘরে ফেরার ঝুঁকি নিতে চাইছেন না। যে সব স্কুলে ত্রাণ শিবির খোলা হয়েছে, সেখানে পড়াশোনাও বন্ধ। এরই মধ্যে ত্রাণ শিবিরে এসএমএসে হুমকি আসছে, ছড়িয়ে পড়েছে, ‘যেখানে আছো, সেখানেই থাকো। গ্রামে ফেরার চেষ্টা করলেই খুন হয়ে যাবে। মহিলাদের ধর্ষণ করা হবে।’ জেলার পুলিশ-কর্তারা বলছেন, এই এসএমএস-হুমকি আটকানোর ক্ষমতা তাঁদের নেই। তবে রাজ্য পুলিশের ডিজি জয়ন্তনারায়ণ চৌধুরী বলছেন, “সিআইডি-র সাইবার অপরাধ দমন শাখা ও তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগকে কাজে লাগানো হচ্ছে।” রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দারা আবার বলছেন, সংঘর্ষ জিইয়ে রাখার পিছনে এনডিএফবি-র মতো বিভিন্ন জঙ্গি-সংগঠনের হাত রয়েছে। বাইরে থেকেও নমনি অসম ও বড়োভূমিতে জঙ্গিরা ঢুকেছে। পাল্টা প্রশ্ন উঠেছে, এনডিএফবি-র যে সব জঙ্গিরা শান্তিপ্রক্রিয়ায় রাজি হয়েছেন, তাদের অস্ত্র বাজেয়াপ্ত করা হয়নি কেন?
মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, জাতীয় নাগরিক-পঞ্জির কাজ শেষে হয়ে গেলেই অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু তা সময়সাপেক্ষ বিষয়। অসম আন্দোলনের সমাধানে ১৯৮৫ সালে প্রফুল্ল মহন্তদের সঙ্গে রাজীব গাঁধী চুক্তি করেছিলেন। সম্প্রতি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় সেই ‘অসম চুক্তি’-র পুনর্বিবেচনার পরামর্শ দিয়েছেন। বড়ো-চুক্তিও পুনর্বিবেচনার দাবি উঠেছে। কিন্তু সেখানেও রাজনৈতিক চাপানউতোরই বড় হয়ে উঠছে। বড়োভূমির জমিতে বড়োদের অধিকার সুনিশ্চিত করার জন্য ২০০৩ সালে দ্বিতীয় বড়ো-চুক্তির পরে বড়োল্যান্ড আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হয়। কিন্তু যে চারটি জেলা নিয়ে স্বশাসিত পরিষদ গঠন হয়েছে, সেখানে বড়োরাই এখন সংখ্যায় কম। এরই মধ্যে দু’বছর ধরে ব্রহ্মপুত্রের উত্তরপাড় জুড়ে পৃথক বড়োল্যান্ড রাজ্য গঠনের দাবি ওঠে। সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে সংখ্যালঘু সংগঠনগুলি। তাঁদের হয়ে সওয়াল করে, সমর্থন আদায় করে রাজ্য রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি তথা প্রধান বিরোধী দল হয়ে ওঠে এআইইউডিএফ। এই দলের নেতা বদরুদ্দিন আজমলের দাবি, বড়ো চুক্তি বাতিল করতে হবে। ভেঙে দিতে হবে বড়োল্যান্ড স্বশাসিত পরিষদ। বড়ো মহিলা নেত্রী তথা এনডিএফবি-প্রধান রঞ্জন দৈমারির বোন অঞ্জলি দৈমারি বলেন, “সংখ্যালঘুরা প্রচার চালাচ্ছেন বড়োরা এখানে ২০ শতাংশ, ওঁরা ৮০ শতাংশ। কিন্তু শতাংশের হিসাবে আমাদের ভূমি বহিরাগতরা ছিনিয়ে নেবে, তা হতে দেওয়া যায় না।” নমনি অসমের সংঘর্ষকে সর্বভারতীয় রূপ দেওয়ার জন্য বদরুদ্দিন আজমলকেই দায়ী করেছে বড়ো ছাত্র সংগঠন। আজমল শিবিরের পাল্টা দাবি, বিজেপি বা সঙ্ঘ পরিবারের শীর্ষনেতারা অনেক বেশি সাম্প্রদায়িক মন্তব্য করছেন। সংখ্যালঘুদের অনুপ্রবেশকারী তকমা দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে চাইছেন তাঁরা।
এই ঘোলাজলে শক্ত হাতে হাল ধরার কথা পোড় খাওয়া মুখ্যমন্ত্রী গগৈয়ের। কিন্তু তিনি নিজেই এখন ঘর সামলাতে ব্যস্ত। সাংবাদিক বৈঠকে তিনি অভিযোগ তুলেছেন, তাঁরই একদা-ঘনিষ্ঠ এক মন্ত্রী এখন আজমলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে বসতে চাইছেন। তাই রাজ্যে অস্থিরতা কায়েম করার চেষ্টা চলছে। গগৈ শিবিরের বক্তব্য, ওই মন্ত্রীর পরিকল্পনাতেই গুয়াহাটির রাজপথে শ্লীলতাহানি থেকে শুরু করে নানা ঘটনাকে হাতিয়ার করে রাজ্য সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার চেষ্টা চলছে। প্রমাণ করার চেষ্টা চলছে, রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসেবেও গগৈ ব্যর্থ। ত্রাণ শিবিরগুলিতে যখন স্থাস্থ্য পরিষেবার শোচনীয় হাল, তখন সেই দফতরের মন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা পদত্যাগের ইচ্ছার কথা জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি পাঠিয়েছেন বলেও কংগ্রেস সূত্রের খবর।
মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে হ্যাটট্রিক করা গগৈ তাই ঘরে-বাইরের সমস্যায় জর্জরিত। অসমের গাঁ-গঞ্জ-নগরের সাধারণ মানুষগুলিও। |