সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে।
ভারত-মার্কিন পরমাণু চুক্তির বীজ পোঁতা হয়েছিল অটলবিহারী বাজপেয়ীর জমানায়। অথচ মনমোহন সিংহ যখন পরমাণু চুক্তি রূপায়ণে এগিয়েছিলেন, তখন স্রেফ ‘রাজনৈতিক কারণে’ বিরোধিতা করেছিল বিজেপি। পাঁচ বছর পরে আর্থিক সংস্কারের ক্ষেত্রেও একই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। বিশ্ব জুড়ে যখন আরও এক বার মন্দার ছায়া, তখন সংস্কারের ক্ষেত্রে এই ‘রাজনৈতিক ঐকমত্যের অভাব’ই মনমোহনের কাছে মূল উদ্বেগ। সরকারের অভিযোগ, মতাদর্শগত ভাবে সংস্কারের পক্ষে হলেও রাজনৈতিক কারণে বাধা দিচ্ছেন বিরোধীরা। এমন একটা অবস্থায় তাই শরিকদের বুঝিয়ে রাজি করাতে চাইছেন মনমোহন।
প্রধানমন্ত্রী সচিবালয় সূত্রে বলা হচ্ছে, মনমোহনের নির্দেশে আগামিকাল তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলোচনার জন্য কলকাতায় যাচ্ছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী তথা সরকারের অলিখিত ‘নম্বর টু’ ব্যক্তি এ কে অ্যান্টনি। বহু ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নি বা ফরওয়ার্ড ট্রেডিংয়ের মতো সংস্কারের সঙ্গে জড়িত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি নিয়ে তিনি মমতাকে বোঝানোর চেষ্টা করবেন। কলকাতায় রাজ্য সরকার সূত্রের খবর, আগামী সপ্তাহে সমন্বয় কমিটির যে বৈঠকটি হতে চলেছে, তাতে যোগ দিতে সম্ভবত ২২ তারিখ দিল্লি যাবেন মমতা।
মমতার পাশাপাশি ইউপিএ-র দুই সমর্থক মুলায়ম সিংহ এবং মায়াবতীকেও বোঝানোর চেষ্টা শুরু হয়ে গিয়েছে। কংগ্রেস শীর্ষ সূত্রে বলা হচ্ছে, শরিকদের বুঝিয়ে রাজি করতে সনিয়া নিজেও সক্রিয়। আগামী সপ্তাহে ইউপিএ-র সমন্বয় কমিটির বৈঠকেও তিনি উপস্থিত থাকতে পারেন।
কংগ্রেসের এক শীর্ষ নেতার কথায়, গোড়ার দিকে সংস্কার নিয়ে কংগ্রেস তথা কেন্দ্র আপস করেছে। কিন্তু এখন হাতে আর বেশি সময় নেই। লোকসভা ভোটের আর দেড় বছর বাকি। তাই মরিয়া হয়েই প্রধানমন্ত্রী শরিকদের সঙ্গে আলোচনা করে জট খুলতে চাইছেন। তাই আসন্ন ইউপিএ সমন্বয় কমিটির বৈঠকটি তাৎপর্যপূর্ণ। তবে শরিকদের বোঝানো কতটা কঠিন, মন্ত্রিসভার বৈঠকে পরে তারই ইঙ্গিত দিয়েছেন রেলমন্ত্রী মুকুল রায়। বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে ফরওয়ার্ড ট্রেডিং বিলটি ছিল না। তার পরে মুকুল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। পরে রেলমন্ত্রী জানান, গত ১৫ বছর বিষয়টি আলোচনায় রয়েছে। তাই এ নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের আগে আরও চুলচেরা আলোচনা দরকার। রাজ্যের কথাও শুনতে হবে কেন্দ্রকে। এ সবের পাশাপাশি তাঁদের মূল উদ্বেগ যে প্রান্তিক চাষিরা, সে কথাও
আরও এক বার প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন রেলমন্ত্রী।
কংগ্রেসের ওই নেতা আরও বলছেন, মতাদর্শগত ভাবে বিজেপি সংস্কারের পক্ষে। কিন্তু দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের শরিক দল তৃণমূল কোনও বিষয়ে বাধা দিলেই প্রধান বিরোধী দল তা থেকে ফায়দা তুলতে তৎপর হয়েছে। তাই খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নিতে বাধা দিয়েছে তারা। এমনকী, যে নরেন্দ্র মোদী গুজরাতে পুরোদমে সংস্কারের কাজ করছেন, তিনিও পণ্য-পরিষেবা কর বা জিএসটি নিয়ে আপত্তি তুলেছেন।
বিরোধীদের সম্পর্কে সরকার যতই অসহযোগিতার অভিযোগ তুলুক, বিজেপি নেতারা কিন্তু তা মানছেন না। অরুণ জেটলি বলেন, “দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের আমলে প্রশাসনের ব্যর্থতা, সরকারের নেতৃত্বের সঙ্কট এবং নীতিহীনতাই বারবার প্রমাণিত হচ্ছে। নিজেদের সেই ব্যর্থতা বিরোধীদের ঘাড়ে চাপিয়ে দায় ঝেড়ে ফেলতে চাইছে সরকার। কিন্তু তা সম্ভব নয়।”
বিরোধীদের বক্তব্য, সঙ্কটমোচনে প্রণব মুখোপাধ্যায় এত দিন যে ভূমিকা নিয়ে এসেছেন, যে ভাবে সকলের সঙ্গে সমন্বয় করে চলেছেন, মনমোহন-চিদম্বরম বা মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়া, কারও পক্ষেই তা করা সম্ভব নয়। সংসদ শুরুর আগে বিজেপি নেতাদের সঙ্গে দেখা করে সংস্কারের বিভিন্ন বিল নিয়ে আলোচনা করে এসেছেন চিদম্বরম। বিরোধীদের আপত্তি দেখে তাঁদের তিনি এ কথাও জানিয়েছেন, রাজনৈতিক ঐকমত্য না হলে সংসদের চলতি অধিবেশনে সংস্কার সংক্রান্ত ‘স্পর্শকাতর’ বিলগুলি আনা হবে না।
পণ্য-পরিষেবা কর সংক্রান্ত বিলটি এখন অর্থ মন্ত্রকের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে। কমিটির চেয়ারম্যান যশবন্ত সিনহা জানান, এই বিলটি সংসদের চলতি অধিবেশনেই
পেশ করার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছিল কমিটি। কিন্তু গত মাসের ২৭ তারিখ অর্থ মন্ত্রকের কাছে তাঁরা যে প্রশ্নগুলি রেখেছিলেন, এক সপ্তাহের মধ্যে সেগুলির জবাব দেওয়ার কথা বললেও কার্যক্ষেত্রে এক মাসেও তা দিয়ে উঠতে পারেননি মন্ত্রকের কর্তারা। যশবন্তের মতে, “এর থেকেই
স্পষ্ট, সরকারের ঢিলেমির জন্যই বিলটি চলতি অধিবেশনে আনা সম্ভব হল না।”
অর্থ মন্ত্রকের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সিপিআই নেতা গুরুদাস দাশগুপ্তের মতে, “পণ্য-পরিষেবা কর নিয়ে এত দিন সরকার অনেক দাবিই করে আসছে। সেগুলির ব্যাখ্যা চেয়েছিল স্থায়ী কমিটি। এখন তার কোনও জুৎসই জবাব তারা দিতে পারছে না।” |