প্রকল্পের জন্য সরকার মোটা অঙ্কের ঋণ দিয়েছিল। কিন্তু সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ার পরেও তা শোধ করেননি অনেক বিনিয়োগকারী। বকেয়ার মোট অঙ্ক প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। সেই টাকা আদায়ে চলতি সপ্তাহ থেকে প্রায় ২০০ জন ঋণ-খেলাপি প্রকল্প-মালিকের কাছে নোটিস পাঠাতে শুরু করেছে রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগম (ডব্লুবিআইডিসি)।
নিগমের নোটিসে বলা হয়েছে, গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত নিগম থেকে যে টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে, সেই বকেয়া এক মাসের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। সময় পেরিয়ে গেলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সংস্থার নামও প্রকাশ্যে জানিয়ে দেওয়া হবে। সরকারি সূত্রের খবর, ঋণ-খেলাপির তালিকায় বেশ কয়েকটি ঐতিহ্যশালী ও বড় মাপের সংস্থার নামও রয়েছে।
এ রাজ্যে বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ বিভিন্ন সময় সরকারের কাছ থেকে জমি ও প্রকল্প-ঋণ পেয়েছেন। নতুন সরকারের অভিযোগ, শিল্প করবেন বলে সরকারের কাছ থেকে জমি নিয়ে অনেকে কিছুই করেননি। কেউ কেউ আবার শিল্পের জমিতে আবাসন-সহ অন্য কিছু করেছেন। একই ভাবে, কোনও প্রকল্পের জন্য শিল্পোন্নয়ন নিগমের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন অনেকে।
কিন্তু সময় পেরিয়ে গেলেও অনেকে ঋণের পুরো টাকা শোধ করেননি।
যাঁরা শিল্পের জন্য সরকারের কাছ থেকে জমি নিয়ে ফেলে রেখেছেন, তাঁদের সেই জমি ফেরত দেওয়ার জন্য বার বার আবেদন জানিয়েছে সরকার। এমনকী, ভূমি সংস্কার আইনের ধারা সংশোধন করেও বিনিয়োগকারীদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, ভবিষ্যতে নতুন নেওয়া জমিতে তিন বছরের মধ্যে প্রকল্প তৈরি না হলে সেই জমি ফিরিয়ে নেবে সরকার। প্রশাসনের একটি অংশের বক্তব্য, জমি ফেরতের ব্যাপারে সরকার এখনও কিছুটা নরম মনোভাব দেখালেও ঋণের টাকা ফেরত পেতে কঠোর মনোভাব নেওয়া হয়েছে। রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানান, ১৯৮৩ সাল থেকে প্রায় ১৭৬ জন নিগমের কাছ থেকে প্রকল্পের জন্য ঋণ নিয়ে তা পুরোপুরি শোধ করেননি। বকেয়া প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। তা আদায় করতেই সংশ্লিষ্ট প্রকল্প-মালিকদের কাছে নোটিস পাঠানো শুরু হয়েছে।
নোটিস পেয়েও ঋণের টাকা ফেরত না দিলে কী ব্যবস্থা নেবে সরকার? শিল্পমন্ত্রীর জবাব, “আগে দেখা যাক নোটিসের কী উত্তর দেন ওঁরা। তার পর বাকিটা ঠিক করা হবে।” একই প্রশ্নে নিগমের মুখপাত্র জানান, ঋণ দেওয়ার সময় সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের জমি-বাড়ি-যন্ত্রাংশের মতো গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি অংশ ‘মর্টগেজ’ হিসাবে রাখা হয়। ঋণ শোধ না করলে মর্টগেজ-এ থাকা সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে তা বিক্রি করে দিয়ে টাকা আাদায় করা হয়। ঋণ-খেলাপিদের বিরুদ্ধে নিগমের এই ব্যবস্থা অবশ্য নতুন নয়। তবে আগে এ সব হত বিক্ষিপ্ত ভাবে। এই প্রথম সংগঠিত ভাবে, বড় আকারে অভিযান চালানো হচ্ছে, দাবি নিগম-কর্তাদের।
শিল্প প্রকল্পের জন্য নিগম তার নিজস্ব তহবিল থেকে দু’ভাবে ঋণ দেয়। একটি সরাসরি ঋণ (টার্ম লোন), অন্যটি বিক্রয় কর ঋণ (সেল্স ট্যাক্স লোন)। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ফি বছর সরকারের প্রাপ্য বিক্রয় করের টাকাটাই সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে ঋণ হিসাবে দেওয়া হয়। দুই ক্ষেত্রেই ঋণের ন্যূনতম পরিমাণ ১০ কোটি টাকা। সুদের হার এখন ১১% থেকে ১৩%।
নিগমের মুখপাত্র জানান, সাধারণত প্রকল্পের মোট খরচের অর্ধেক টাকা ঋণ হিসাবে দেয় নিগম। তথ্যপ্রযুক্তি, ফুড পার্কের মতো প্রকল্প হলে সর্বাধিক ৫ বছরের মধ্যে ঋণের টাকা পরিশোধ করার কথা। অন্য ধরনের প্রকল্পের ক্ষেত্রে ফেরত দেওয়ার সময়সীমা ৭ বছর।
নিগম সূত্রের খবর, ঋণ নিয়ে কোনও টাকাই শোধ করেননি, এমন নজির নেই বললেই চলে। ঋণ-খেলাপিদের সিংহভাগই ঋণের একটি অংশ বকেয়া রেখে দিয়েছেন। নোটিসের সঙ্গে তাই একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে। তাতে মূল ও সুদ মিলিয়ে কত টাকা বকেয়া, কবে থেকে বকেয়া, কী কাজে টাকা দেওয়া হয়েছিল, তার বিস্তারিত তথ্য দেওয়া হয়েছে। এই নোটিসকে ‘খুব জরুরি’ ভিত্তিতে দেখার কথাও উল্লেখ করেছে নিগম।
শিল্পের ফেলে রাখা জমি ফেরত চেয়ে সরকারের বহু আবেদনে কাজ হয়নি কিছুই। এ বার বকেয়া টাকা আদায়ের এই উদ্যোগ কতটা সফল হয়, সেটাই দেখার। |