রফতানিতে ভাটার দৌলতে ক’দিন না-হয় বাঘা বাগদা পাতে পড়ছে। কিন্তু শুধু চিংড়িতে কি মৎস্যরসিক বাঙালির মন ভরে? ভরা বর্ষাতেও ইলিশ প্রায় উধাও, রুই-কাতলা-ভেটকি-পাবদা কিংবা ট্যাংরা-বোয়াল-পারশের মতো নিত্য দিনের চেনা মাছগুলোও দিন দিন দুর্লভ হয়ে উঠছে! মৌরলা-পুঁটি-কাজরি-আমোদি তো ইতিহাসের খাতায়।
তা হলে কি ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ প্রবাদটা ভোলার সময় হল?
বাজারে সাধারণ মাছের আকাল আর লাগামছাড়া দাম এই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের আম বাঙালিকে। মৎস্যজীবী, ভেড়ি-মালিক, আড়তদার থেকে শুরু করে মৎস্য-বিজ্ঞানী, এমনকী খোদ রাজ্যের মৎস্যমন্ত্রীও সঙ্কট সম্পর্কে সম্যক অবহিত। তাঁরা মানছেন, রোজকার পাতে যে সব মাছ ছাড়া বাঙালির ভাত রোচে না, সেই রুই-কাতলা-মৃগেল-পারশেও ক্রমশ মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।
এবং এ জন্য মাছের সার্বিক উৎপাদনে ঘাটতির দিকেই আঙুল তুলছে মোটামুটি সব মহল। এ বিষয়ে পরিসংখ্যানগত কোনও তথ্য অবশ্য রাজ্যের মৎস্য দফতরের কাছে নেই। মৎস্যমন্ত্রী আবু হেনার দাবি, “জোগান বিশেষ কমেনি। কমলেও ১০-১৫ শতাংশের বেশি নয়।” তবে মন্ত্রীর ‘অনুমাননির্ভর’ তথ্য কার্যত ফুৎকারে উড়িয়ে দিচ্ছে উৎপাদক ও ব্যবসায়ী মহলের একাংশ। যেমন উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়ার ভেড়ি-মালিক শেখ খুরশিদ আলম বলছেন, “মাছ উঠছে অনেক কম। এতটাই যে, লগ্নির টাকা ডুবে যাওয়ার জোগাড়!” হাড়োয়ার বুড়িরডাঙা মাছ-বাজারের আড়তদার অষ্টপদ মণ্ডলের আক্ষেপ, “সাদা মাছের (পাবদা-পারশে-আড়-বেলে-বোয়াল-ট্যাংরা ইত্যাদি) জোগান বিস্তর মার খাচ্ছে। পারশে তো নেই বললেই চলে!”
কেন এই অবস্থা?
বিশেষজ্ঞেরা কোনও একটি কারণকে চিহ্নিত করতে নারাজ। তাঁদের মতে, বৃষ্টির খামখেয়ালিপনা, নদী-সমুদ্রে নিয়ন্ত্রণহীন মাছ ধরা কিংবা অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মাছ-চাষ থেকে আরম্ভ করে জীবাণু সংক্রমণ, যথেচ্ছ মিন সংগ্রহ এমন বিভিন্ন কারণের সম্মিলিত প্রতিক্রিয়ায় এ হেন দুরবস্থা। বোঝার উপর শাকের আঁটি হয়েছে রফতানি। ব্যবসায়ী সূত্রের খবর: সপ্তাহে পাঁচ দিন রাজ্য থেকে বিপুল পরিমাণ রুই-কাতলা ও ‘সাদা মাছ’ বাংলাদেশে চালান হয়ে যাচ্ছে। এক কারবারির দাবি, “অন্ধ্রের লরিবোঝাই রুই-কাতলা পশ্চিমবঙ্গে এলেও বড় অংশ চলে যাচ্ছে ও-পারে।”
|
আর রফতানির বাজারে ভাল জাতের বড় মাছেরই কদর বেশি বলে জানাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে স্থানীয় বাজারে তার আনাগোনা আরও কমছে। যেটুকু মিলছে, আকাশছোঁয়া দাম। সল্টলেকের এফডি মার্কেটের মাছ-ব্যবসায়ী কৃষ্ণ মাঝি বলেন, “জোগান কম হওয়ায় ভেড়ি-মালিকেরা বেশি দামে মাছ বেচছেন আড়তদারকে। তাঁদের থেকে আমরাও কিনছি চড়া দামে। খদ্দেরের কাছে বেশি দর না-হেঁকে উপায় কী?” কৃষ্ণবাবু হিসেব দেন “আড়তদারেরাই রুই কিনছে ১০৫-১১০ টাকা কেজি’তে। আমরা নিচ্ছি ১২০-১২৫ টাকায়। লাভ রাখতে হলে খুচরো দাম তো বাড়বেই!” পাশাপাশি মাছ-চাষিদের অভিযোগ: ডিমপোনা (মিন)-র দাম অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় পারশে-ভাঙর-ভেটকি-পাবদা-তপসে-ট্যাংরার উৎপাদন কমছে। বাগদা চিংড়ির মতো নোনা জলের এই মাছগুলোর ডিমপোনা ধরা হয় সুন্দরবনের খাঁড়িতে। মশারির চেয়েও ছোট ফুটোর জাল নৌকোয় খাটিয়ে জোয়ারের সময়ে মাঝ-নদীতে নির্বিচারে মিন ধরা হয়। স্থানীয় মেয়ে-বৌরাও রুজির টানে ব্যাপক হারে মিন ধরেন। মিন বাছাইয়ের সময়েই অধিকাংশ চারা মারা পড়ে। এ ভাবে ডিমপোনায় টান পড়ে গিয়েছে। ফলে সঙ্কটে পড়েছে ভেড়ি। দুই ২৪ পরগনার যে সমস্ত নোনা জলের ভেড়িতে পারশে-ভাঙরের চাষ হয়, সেগুলো সবই নদীর সঙ্গে যুক্ত। হাড়োয়ার ভেড়ি-মালিক কমল ঘোষ জানাচ্ছেন, “১৫-২০ বছর আগেও এপ্রিল-মে মাসে জোয়ারের জলের সঙ্গে নানা মাছের ডিমপোনা ঢুকে পড়ত। তা দিয়েই চাষ হত। এখন মিন ফেলতেই হয়। অথচ তার দাম আগুন।” এ ভাবে বে-লাগাম মিন-শিকার চললে নোনা জলের সুস্বাদু মাছগুলোই এক দিন বিলুপ্ত হয়ে যাবে বলে তাঁর আশঙ্কা।
বস্তুত ছোট ফাঁদের জালে নিয়ন্ত্রণহীন শিকারের পরিণতিতে নদীগুলো কার্যত মাছশূন্য। বিশেষত গঙ্গা, রূপনারায়ণ, দামোদর-সহ দক্ষিণবঙ্গের মৎস্যভাণ্ডার তো নিঃস্ব। সেন্ট্রাল ইনল্যান্ড ফিশারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউট মাছের ডিম পাড়া ও ডিম ফোটার সময় অন্তত ১৫ দিন নদীতে মাছ ধরা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে আইন প্রণয়নের সুপারিশ করলেও তা কার্যকর হয়নি। চার ইঞ্চির ছোট ফাঁসের জাল নিষিদ্ধ করে বাম আমলে তৈরি আইনটিও কার্যত ঠুঁটো হয়ে রয়েছে বলে অভিযোগ। |
প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা, বিশেষত অনিয়মিত বৃষ্টিপাতও মাছ-সঙ্কটের একটা বড় কারণ বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা। তাঁদের বক্তব্য: মাছের জীবনচক্রে যার ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ, সেই মৌসুমি বৃষ্টিপাত পিছিয়ে যাওয়ায় আবর্তে ছেদ পড়েছে। সিআইএফআরআই-এর অধিকর্তা অনিলপ্রকাশ শর্মার কথায়, “জুন থেকে অগস্টের মধ্যে ডিম পেড়ে বাচ্চা ফোটানোর জন্য মাছ সাধারণত মৌসুমি বৃষ্টির উপরে নির্ভর করে। বর্ষা পিছু হটায় ডিমপোনা উৎপাদন ধাক্কা খেতে বাধ্য।” অনেক ক্ষেত্রে ভাইরাস-ব্যাক্টেরিয়া সংক্রমণে ভেড়িতে মড়ক লেগেও বিপর্যয় ঘটছে। হাড়োয়ার শেখ খুরশিদ জানালেন, তাঁর প্রায় ১০০ বিঘের তেলাপিয়া মড়ক লেগে এক দিনে শেষ হয়ে গিয়েছে।
অন্য দিকে পূর্ব কলকাতা জলাভূমির মোট যে প্রায় চার হাজার হেক্টর জলের ভেড়িগুলো মহানগরের চাহিদা অনেকটা মেটায়, সেখানে উৎপাদন মার খেয়েছে জলের অভাবে। ওখানে কলকাতা পুরসভার নিকাশি নোংরা জল ঢুকিয়ে তা প্রাকৃতিক উপায়ে পরিষ্কার করে রুই-কাতলা-মৃগেল-বাটা-তেলাপিয়া-গ্রাস কার্প-সিলভার কার্প-কালবোসের চাষ হয়। বছরে ওঠে প্রায় ১২ হাজার টন। কিন্তু মৎস্যজীবীদের অভিযোগ: নিকাশির জল সে ভাবে ভেড়িতে ঢুকছে না। ছোট গোপেশ্বর ভেড়ির মৎস্যজীবী বলাই ঘোষ-হরিদাস জেলের কথায়, “নোংরা জল যে খাল দিয়ে বিদ্যেধরীতে পড়ে, লকগেট বন্ধ করে তার জল উপচিয়ে ভেড়িতে ঢোকানো হতো। এখন লকগেট বন্ধ করা হচ্ছে না।” ওঁদের আরও অভিযোগ, পলি জমে ভেড়ির গভীরতা কমায় জলের তাপমাত্রা বাড়ছে। তাতে মাছের সংখ্যা বাড়ছে না, মাছের খাদ্যেও টান পড়ছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র-বিজ্ঞান বিভাগের অধিকর্তা সুগত হাজরাও মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তন ও জলের তাপমাত্রাবৃদ্ধি মাছের উৎপাদন হ্রাসের বড় কারণ। তাঁর ব্যাখ্যা, “তাপ বাড়লে জলে দ্রবীভূত অক্সিজেন কমতে থাকে। তাতে মাছের খাদ্যে টান পড়ে। প্রজনন ব্যাহত হয়।”
নদী-ভেড়ির এই হাল হলেও সমুদ্রের মাছ তো আছে? বাঙালির ঐতিহ্যের দেশি মাছেরই বা কী হল?
তথ্য বলছে, পশ্চিমবঙ্গে মাছের মোট উৎপাদনের ১৭ শতাংশ সামুদ্রিক। কিন্তু তাতেও ভাটার টান। যার প্রধান কারণ, মোহনা থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত সমুদ্র জুড়ে ছোট ফাঁদের জাল দিয়ে নির্বিচারে মাছ তোলা। আর মৌরলা-পুঁটি-খয়রা-চ্যালা-বাচা-দাঁড়কে-কাজরি-আমোদি-কেঁকলে-সোনাখোরকে-চাঁদা-বাতা-খোলসের মতো দেশি বা চুনো মাছ তো ক্রমেই স্মৃতি হয়ে যাচ্ছে। কারণ, যে সব খাল-বিল বা পতিত জলায় এগুলো নিজে থেকে বেড়ে উঠত, সেখানে সংগঠিত ভাবে মাছ চাষ হচ্ছে। আমন ধানের যে জমিতে জমে থাকা বর্ষার
জল ছিল চুনো মাছের প্রাকৃতিক আবাস, রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের বিষে তা জর্জরিত।
বাঙালির মীন-ভাগ্যে কি তা হলে শুধুই অন্ধকার? উত্তর দেবে সময়ই। |
সহ প্রতিবেদন: বিতান ভট্টাচার্য |