জিম্মা, লাইন, খদ্দের!
হাওড়া স্টেশনে তোলাবাজদের অভিধানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ শব্দ এগুলো। জবরদস্তি ট্রেনের আসন দখল করে চড়া দামে ‘বিক্রি’ করা থেকে রেল গুদামে জিনিসপত্র রেখে অবৈধ ভাবে টাকা রোজগারের যে রমরমা চলছে হাওড়া স্টেশনে, তাতেই ব্যবহার হয় এ সব সাঙ্কেতিক শব্দ।
সপ্তাহখানেক আগে হাওড়া স্টেশনের ২২ নম্বর প্ল্যাটফর্মে শ্রীরামপুরের যুবক বিভাস পালকে টানা আট ঘণ্টা আটকে রেখে মারধর করার অভিযোগ ওঠে। সেই ঘটনার তদন্তে নেমে রেল পুলিশ এই তথ্য জানতে পেরেছে। রেল পুলিশের দাবি, হাওড়া স্টেশনের ৯ থেকে ১৪ এবং ১৯ থেকে ২৩ নম্বর প্ল্যাটফর্মে কয়েক বছর ধরে তোলাবাজদের চক্র সক্রিয়। অভিযোগ, ওই চক্রে আরপিএফ জওয়ানদের একাংশের পাশাপাশি প্ল্যাটফর্মের কিছু হকারও জড়িত।
রেল পুলিশ ও স্থা্নীয় সূত্রের বক্তব্য, অনেক দিন ধরেই বেআইনি এই কারবারের রমরমা হাওড়া স্টেশনে। স্টেশনের গুডস শেডে জিনিসপত্র রাখার যে জায়গা রয়েছে, তারই কিছুটা কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা বা ব্যক্তিকে ভাড়া দেওয়া রয়েছে। ওই সংস্থা বা ব্যক্তিকে বলা হয় ‘লিজ হোল্ডার।’ নিয়ম অনুযায়ী রাতে ওই শেডে জিনিসপত্র রাখতে পারেন না লিজ হোল্ডাররা। কিন্তু চক্রের হাতে মনপসন্দ তোলা দিলে রাতেও তাঁদের নিজেদের জিনিস রাখার ব্যবস্থা দিব্যি হয়ে যায়। স্টেশনে এই ব্যবস্থাকে সহজ কথায় বলা হয় ‘জিম্মা’।
এ ছাড়া, হাওড়া স্টেশনে বিভিন্ন দূরপাল্লার ট্রেনে অসংরক্ষিত কামরাগুলির প্রায় ৪০ শতাংশ আসন দখল করে রাখে ওই চক্রের লোকজন। যাত্রীদের কাছে এক একটি আসন বিক্রি হয় ১০০ থেকে ১৫০ টাকায়। এই ব্যবস্থার চালু নাম ‘লাইন’। প্রতি দিন হাওড়া স্টেশন থেকে প্রায় ২৫টি দূরপাল্লার ট্রেন ছাড়ে। ওই সব ট্রেনে অসংরক্ষিত কামরায় আসন পাওয়া নিশ্চিত করতে হলে চক্রের হাতে টাকা দিতেই হবে।
বিভিন্ন দূরপাল্লার ট্রেনে বা লোকাল ট্রেনে বেআইনি ভাবে ভ্রমণ করা যাত্রীদের বলা হয় ‘খদ্দের’। চক্রের লোকজন ওই যাত্রীকে চিহ্নিত করে ট্রেন থেকেই খবর পাঠিয়ে দেয় হাওড়া স্টেশনে থাকা নিজেদের লোকেদের কাছে। ট্রেন প্ল্যাটফর্মে থামার পরই সক্রিয় হয়ে ওঠে চক্রের লোকজন। হাতেনাতে ওই যাত্রীকে পাকড়াও করে নানা ভাবে চলে হেনস্থা। এর পর দাবিমতো টাকা দিলে তবেই রেহাই। না হলে শুরু হয় চড়-থাপ্পড়। কেড়ে নেওয়া হয় জিনিসপত্র। যেমনটি হয়েছিল গত ৭ অগস্ট শ্রীরামপুরের যুবক বিভাস পালের ক্ষেত্রে।
হাওড়া স্টেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত আরপিএফের সিনিয়র কমান্ড্যান্ট অরোমা সিংহ ঠাকুর এ দিন অবশ্য আরপিএফের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, “এমন কোনও অভিযোগ আমাদের কাছে আসেনি। তবে বিভাস পালের ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত চলছে। সব কিছুই খতিয়ে দেখা হবে।”
অভিযোগ, ওই দিন আরপিএফের কয়েক জন জওয়ান ২২ নম্বর প্ল্যাটফর্মের উপরে দফতরের একটি ঘরে আটকে রেখে বেদম মারধর করে বিভাসকে। গুরুতর আহত ওই যুবককে পরে তাঁর এক বন্ধু প্ল্যাটফর্ম থেকে উদ্ধার করে হাওড়া জেলা হাসপাতালে ভর্তি করেন। পরে আরপিএফের এসআই তরুণকুমার বিশ্বাস, এএসআই এ রজক এবং হেড কনস্টেবল উত্তম দেবনাথের বিরুদ্ধে রেল পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন বিভাসের বাবা বিমলকুমার পাল। ঘটনার পরের দিন অভিযুক্ত তিন জনকে সাসপেন্ড করে আরপিএফ।
রেল পুলিশের সুপার মিলনকান্তি দাস বলেন, “ওই তিন জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। ওরা থাকতে পারে, এমন সব জায়গায় তল্লাশি চলছে। ওদের গ্রেফতারের ব্যাপারে আরপিএফের কাছেও সাহায্য চাওয়া হয়েছে।” |