তিন দশকের বেশি সময় ধরে উত্তরবঙ্গের ছয় জেলা জুড়ে ‘ঢিমেতালে’ তিস্তা সেচ প্রকল্পের কাজ চলছে। জাতীয় প্রকল্পের স্বীকৃতি পাওয়া এই প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ এখনও শেষই হয়নি। উচ্চ পদস্থ আধিকারিকেরা বসছিলেন কলকাতায়, জলসম্পদ ভবনে। এতে কাজের নজরদারি, তদারকির কাজে উদাসীনতার অভিযোগ বরাবরই ছিল। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছিল যাতায়াত-সহ আনুষাঙ্গিক বিপুল খরচের অভিযোগও। ক্ষমতায় এসে কয়েক মাসের মধ্যেই প্রথমেই প্রকল্পের এক চিফ ইঞ্জিনিয়ার-সহ তাঁর পুরো দফতরকে উত্তরবঙ্গে পাঠিয়ে দিয়েছে রাজ্যের নতুন জোট সরকার। এবার প্রকল্পের কাজে আরও গতি আনতে আরেক চিফ ইঞ্জিনিয়ারকেও কলকাতা থেকে উত্তরবঙ্গে পাঠানো সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সেচ দফতর। সরকারি সূত্রের খবর, সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী এক মাসের মধ্যে প্রকল্পের চিফ ইঞ্জিনিয়ারকে (নির্মাণ) পাকাপাকিভাবে উত্তরবঙ্গে বসবেন। এতদিন ওই আধিকারিককে দক্ষিণবঙ্গের আয়লা বিধ্বস্ত এলাকার পুর্নগঠনের কাজে তদারকির দায়িত্বে রাখা হয়েছিল। শিলিগুড়ি অথবা উত্তর দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জে তাঁর দফতর তৈরি হবে। পাশাপাশি, আরও তিনটি বিভাগকে শিলিগুড়ি তিস্তা সেচ ভবন থেকে উত্তর দিনাজপুরের পাঠানো হতে পারে। এরমধ্যে মেক্যালিক্যাল ক্যানেল ডিভিশন, টেকনিক্যাল রিসর্স ডিভিশন এবং ডিজাইন ডিভিশন রয়েছে। জেলাতেই মূলত প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেচ দফতর। রাজ্যের সেচমন্ত্রী মানস ভুঁইয়া বলেন, “বাম আমলে উদাসীনতা, অবহেলা, দুর্নীতি-সহ নানা কারণে তিস্তা প্রকল্পের আজ এই হাল। তিন দশক ধরে কী হয়েছে তা আমরা সবাই দেখেছি। সবচেয়ে অদ্ভুত হল, প্রকল্পের কাজ এক জায়গায় হচ্ছে, আধিকারিকেরা থাকছেন আরেক জায়গায়। এটা হতে পারে না। এক চিফ ইঞ্জিনিয়ারকে পাঠানো হয়েছে। আরেকজনকে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রকল্পের উচ্চ পদস্থ আধিকারিকেরা উত্তরবঙ্গে থেকে কাজ করবেন।” সেচ দফতর সূত্রের খবর, প্রকল্পের প্রথম থেকেই প্রকল্পের চিফ ইঞ্জিনিয়ার (তিস্তা ব্যারেজ প্রজেক্ট বা টিবিপি) কলকাতায় বসতেন। আর শিলিগুড়ির দুই মাইল এলাকায় চিফ ইঞ্জিনিয়ার (নির্মাণ) দফতর ছিল। দীর্ঘদিন পদটি ফাঁকা ছিল বলে অভিযোগ। ২০১০ সালে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে পদে থাকা এক আধিকারিককে দক্ষিণবঙ্গের আয়লা বিধ্বস্ত এলাকার পুনর্গঠনের দায়িত্বে রাখা হয়। এর পরেই তিস্তা নিয়ে সরকারের উদাসীনতার অভিযোগ তুলে সরব হয় তৎকালীন কংগ্রেস, তৃণমূলের মত বিরোধী দলগুলি। কয়েকজন আধিকারিক জানান, ক্ষমতায় এসে নতুন সরকার জমি সংক্রান্ত ১৫০ উপর মামলা ও ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অফিসার, দফতরকে সাজার কাজই শুরু করেছে। দীর্ঘদিন এক জায়গা থাকা অফিসার কর্মীদের বদলি করা হচ্ছে। এই প্রক্রিয়া চলছেই। সেচমন্ত্রী বলেন, “মূলত কোচবিহার এবং উত্তর দিনাজপুরে বহু জমি সংক্রান্ত মামলা রয়েছে। আমি ছয়বার উত্তরবঙ্গ সফরে গিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করে বিষয়গুলি নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করেছি। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব-সহ অন্যান্য মন্ত্রী, বিধায়কদের বিষয়টি দেখতে বলেছি। একটি মনিটারিং কমিটিও গঠন করা হয়েছে। আমরা দ্রুত প্রকল্পের কাজ শেষ করতে বদ্ধপরিকর।” ১৯৭৬-৭৭ সাল নাগাদ রাজ্যের তো বটেই উত্তরবঙ্গের এই বৃহৎ প্রকল্পে হাত দেয় রাজ্য সরকার। প্রকল্পটি শেষ হলে উত্তরবঙ্গের ছয় জেলায় ৯.২২ লক্ষ হেক্টর জমিতে সেচের জল পৌঁছানোর লক্ষ্যমাত্রা ঠিক হয়। পাশাপাশি, প্রায় ৬৮ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের উৎপাদনের লক্ষ্যও ধার্য হয়। প্রথম পর্যায়ের কাজ শুরু হয়। একমাত্র তিস্তা, মহানন্দা এবং ডাউক ব্যারেজের কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। বাকি প্রধান, শাখা এবং উপ শাখা ক্যানেলের বেশির ভাগ কাজই। ৯০ দশকে কেন্দ্রীয় সরকার এক দফায় ১৪২ কোটি টাকা মঞ্জুরও করে। পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় ও রাজ্যের মধ্যে ৯০:১০ অনুপাতে টাকা দেওয়ার ঘোষণা করা কেন্দ্র। ২০০৯ সালে প্রকল্পটি জাতীয় প্রকল্পের স্বীকৃতিও দেওয়া হয়। আগামী ২০১৫ সালের মার্চের মধ্যে নির্ধারিত প্রথম পর্যায়ের কাজও শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছে কেন্দ্র। সমস্ত দিক গুছিয়ে এগোতে চাইছে সেচ দফতর। |