ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল ফরাক্কার গঙ্গা ভাঙনে বিধ্বস্ত হোসেনপুরের বাসিন্দাদের। সোমবার দুপুরে ৪ ঘণ্টা ধরে ফরাক্কা ব্যারাজের জেনারেল ম্যানেজারের অফিস ঘেরাও করে বিক্ষোভ দেখালেন ওই চরের গ্রাম থেকে আসা হাজার খানেক মানুষ। বিক্ষোভ চলাকালীনই কয়েকশো মহিলা জেনারেল ম্যানেজারের অফিসে ঢুকে পড়ে ভাঙচুরও করেন। পরে পুলিশ এবং সিআইএসএফের জওয়ানেরা ওই মহিলাদের ওই দফতর থেকে সরিয়ে দেন।
প্রশাসনিক সূত্রে জানা গিয়েছে, গত এক সপ্তাহে হোসেনপুরে অন্তত ৯০টি বাড়ি ধসে গিয়েছে গঙ্গায়। প্রায় ৩০টি বাড়ি গঙ্গায় বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। ফরাক্কার বিডিও সুব্রত চক্রবর্তী বলেন, “হোসেনপুরের অবস্থা যে ভয়াবহ, তা আমরা দেখেছি। পরিস্থিতির কথা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েওছি। জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সঙ্গে ফরাক্কা ব্যারাজ কর্তৃপক্ষকেও সব কথা জানানো হয়েছে। দুর্গতদের ত্রিপল ও ত্রাণ সামগ্রী দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু ত্রাণের থেকেও গ্রামবাসীদের বেশি দাবি ভাঙন রোধের কাজ এখনই শুরু করতে হবে।”
এই দিন বিক্ষোভ সমাবেশে হাজির হয়ে ফরাক্কার কংগ্রেস বিধায়ক মইনুল হক বলেন, “ফরাক্কা থেকে তিন কিলোমিটার দূরের হোসেনপুর চর। কিন্তু বারবার বলা সত্ত্বেও হোসেনপুরের ভাঙন নিয়ে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।” তাঁর দাবি, “এখনই কোনও ব্যবস্থা নেওয়া না হলে ২৩ অগস্ট থেকে জেনারেল ম্যানেজারের দফতরের সামনে অনশনে বসব।” |
কিন্তু ভাঙনের কারণ কী? মুর্শিদাবাদের গঙ্গা ভাঙন প্রতিরোধ দফতরের সুপারিন্টেন্ডিং ইঞ্জিনিয়ার অনীশ ঘোষ বলেন, “নদীর পাড় থেকে পাঁচ ফুট নীচে রয়েছে জল। নদীর অবতল বাঁকগুলিতে দলের প্রবল আঘাতে বালির স্তরে দ্রুত ক্ষয় হচ্ছে। নীচের বালি সরে গিয়ে পাড় বরাবর দেখা দিচ্ছে দীর্ঘ ফাটল এবং তা ভেঙে পড়ছে।” তাঁর কথায়, “এখন ভাঙন রোধের দায়িত্বে ফরাক্কা ব্যারাজ কর্তৃপক্ষের। তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। এ ধরনের ভাহন রদ করতে খাঁচার মধ্যে পাথর ভরে নদীর পাড়ে ফলতে হবে। তা জমাট বদ্ধ হলে ভাঙন বন্ধ হবে।”
ফরাক্কা ব্যারাজের দেনারেল ম্যানেজার অরুণকুমার সিংহ বলেন, “হোসেনপুরে ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা আমরা জানি। আপাতত সেখানে ৫০০ মিটার এলাকা জুড়ে ভাঙন রোধের একটি প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছে। কিন্তু টাকার অভাবে কাজ করা যাচ্ছে না। সোমবার এই নিয়ে বিক্ষোভ দেখাতে এসে আমার অফিসে ভাঙচুর করা হয়েছে।” হোসেনপুরে নদীর পাড়েই বাড়ি ষাটোর্ধ্ব হরেন মণ্ডলের। তিনি বলেন, “সেই ’৯০ সাল থেকেই ভাঙন চলছে। কিন্তু গত ৭ দিনে তা ভয়াবহ আকার নিয়েছে। এমনটা কখনও দেখা যায়নি।” গ্রামেরই বাসিন্দা পঞ্চায়েত সদস্য সবিতা মণ্ডলের কথায়, “চরের গ্রাম বলেই প্রশাসনিক উপেক্ষার শিকার হতে হচ্ছে।”
নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র বলেন, “দুই শতাব্দী ধরেই মুর্শিদাবাদে গঙ্গা তার ডান পাড় ভাঙছে। ফরাক্কা ব্যারাজ তৈরির পরে এই ভাঙন প্রবণতা বেড়েছে। নদী তীরের উঁচু খাড়া পাড়ের পলিস্তর লক্ষ্য করলে দেখা যায় উপরের জমিটার কাদামাটির স্তর যথেষ্ট জমাটবদ্ধ। কিন্তু এর নীচেই রয়েছে সাদা বালির স্তর। এই স্তর খুব ভঙ্গুর। জুনে গঙ্গার জল বাড়তে শুরু করলে স্রোতের গতিও বাড়ে। ফলে ভাঙন বাড়ে।” তাঁর কথায়, “আবার অক্টোবরে নদীর জল কমতে শুরু করলে এই জল আবার নদীতে ফিরে আসবে। এই প্রত্যাবর্তনের সময়েও প্রচুর বালি সরে গিয়ে গহ্বর তৈরি হয় এবং উপরের পাড় ভেঙে যায়।”
মুর্শিদাবাদে ২৬টির মধ্যে ১১টি ব্লক গঙ্গার তীরবর্তী বলে ভাঙনের প্রকোপ রয়েছে। গঙ্গার তীরে গড়ে উঠেছে ধুলিয়ান, লালগোলা, জলঙ্গির মতো শহর। ’৯০ সালে আখরিগঞ্জে ব্যাপক ভাঙনের ফলে হনুমন্তনগর, টিকলিচর, চরকেষ্টপুর, চিলমারি, হাসানপুর, গিরিধারীপুর, রাজাপুর সহ বহু গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। |