যে নার্সিংহোমে নিজের সদ্যোজাত ছেলেকে ভর্তি করিয়েছিলেন, তার পাশের বাড়ির ছাদ থেকে উদ্ধার হল গৃহবধূ নাজিরা বেগমের (২০) রক্তাক্ত দেহ। তবে কী ভাবে তাঁর মৃত্যু হয়েছে তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। রবিবার বিকেলে ওই ঘটনাকে ঘিরে ধুন্ধুমার বাধে উলুবেড়িয়ায়। জনতা নার্সিংহোমটিতে ভাঙচুর করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পুলিশকে লাঠি চালাতে হয়। র্যাফ নামে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, উলুবেড়িয়ারই রোজখোলা গ্রামে বাড়ি নাজিরার। স্বামী শেখ সালাম জরির কারিগর। গত ৩ অগস্ট বাড়িতেই সন্তান প্রসব করেন বধূটি। শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়ায় বাচ্চাটিকে ১০ অগস্ট উলুবেড়িয়া বাজারপাড়ায় ওই নার্সিংহোমে ভর্তি করান ওই দম্পতি। একতলায় শিশু বিভাগে ছেলের সঙ্গেই থাকছিলেন নাজিরা। রবিবার বিকেল ৩টে নাগাদ নাজিরার বৌদি আসমা বেগম সেখানে যান বাচ্চাটিকে দেখতে। আসমার দাবি, “হঠাৎ বাচ্চাটা চিল-চিৎকার করতে থাকে। নাজিরা আমায় বলে, ‘তুমি ছেলেকে ধর। আমি নার্সিংহোমের উপর থেকে ডাক্তারবাবুকে ডেকে আনি।’ ও উঠে যেতে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বসেছিলাম।”
নার্সিংহোমের বাড়িটি চার তলা। কর্তৃপক্ষের দাবি, নীচ থেকে দু’টি তলা ভাড়া নিয়ে তাঁরা নার্সিংহোম চালান। উপরের দু’টি তলা বাড়ির মালিকের। তবে সেখানে কেউ থাকে না। নীচ থেকে সিঁড়ি উঠে গিয়েছে ছাদে। নার্সিংহোমের অন্যতম মালিক মুক্তেশ দে-র বক্তব্য, “সিঁড়ি দিয়ে দোতলা থেকে তিন তলায় ওঠার মুখে আমাদের নিরাপত্তারক্ষীরা ওই ভদ্রমহিলাকে আটকেছিলেন। ওই মহিলা নিরাপত্তা রক্ষীদের বলেছিলেন, ওঁর বাচ্চা নার্সিংহোমে ভর্তি রয়েছে। উনি বিশেষ প্রয়োজনে উপরে যাচ্ছেন। আমরা সাধারণত রোগীদের গতিবিধির উপরে নজর রাখি। মহিলা যেহেতু রোগীর আত্মীয়া, তাই তাঁকে আর বাধা দেননি নিরাপত্তারক্ষীরা।” |
এখানেই পড়ে ছিল বধূর দেহ। হিলটন ঘোষের তোলা ছবি। |
নার্সিংহোমের পাশে ফুট দু’য়েক দূরত্বে রয়েছে একটি ব্যক্তি মালিকানার দোতলা বাড়ি। বিকেল সওয়া ৩টে নাগাদ সেই বাড়ির বাসিন্দারা ছাদে কিছু একটা ভারী জিনিস পড়ার আওয়াজ পান। দ্রুত ছাদে উঠে তাঁরা দেখেন, রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে এক মহিলার দেহ। নাজিরার বৌদি আসমা বেগম বলেন, “ধুপ করে শব্দটা আমিও পেয়েছিলাম। তার পরেই চেঁচামেচি। পাড়ার ছেলেরা রক্তাক্ত অবস্থায় যে দেহটা নিয়ে এল, দেখি সেটা নাজিরার।”
ওই দোতলা বাড়িটিতে গিয়ে এ দিন দেখা যায়, ছাদে যেখানে নাজিরার দেহ মিলেছে, নার্সিংহোমের প্রান্ত থেকে তার দূরত্ব অন্তত ২০ ফুট। ছাদের কংক্রিটে রক্তের দাগ। এলাকাবাসীর একাংশের বক্তব্য, “ভদ্রমহিলা যদি নার্সিংহোমের ছাদ থেকে লাফ দিয়ে থাকেন, তা হলে ওঁর দেহ এত দূরে মেলা প্রায় অসম্ভব। মনে হচ্ছে, ওঁকে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে। ঘটনায় নার্সিংহোমের কারও জড়িত থাকা অসম্ভব নয়।” তাঁদের আরও অভিযোগ, নাজিরাকে যখন উদ্ধার করা হয়, তখন গুরুতর আহত হলেও তিনি বেঁচে ছিলেন। কিন্তু নার্সিংহোমের চিকিৎসক বা নার্সেরা দ্রুত চিকিৎসা শুরু না করায়, বধূটি মারা যান।
মারমুখী জনতা এ দিন বিকেলে নার্সিংহোমের অফিসে ভাঙচুর করে। সব চিকিৎসক এবং নার্সিংহোমের পুরুষ কর্মীরা পালান। শুধু কয়েকজন নার্স ছিলেন। হাঙ্গামা-হট্টগোলে ঘাবড়ে যান রোগী এবং তাঁদের আত্মীয়েরা। খবর পেয়ে পুলিশ এবং র্যাফ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এসডিপিও (উলুবেড়িয়া) শ্যামলকুমার সামন্ত বলেন, “বধূটির অপমৃত্যুর তদন্তের দাবিতে জনতা খেপে উঠেছিল। আমরা দেহটি উদ্ধার করে ময়না-তদন্তের জন্য উলুবেড়িয়া হাসপাতালে পাঠিয়েছি।” কী ভাবে বধূটির মৃত্যু হল, তা নিয়ে ধন্দে রয়েছে পুলিশও। জেলা পুলিশ সুপার (গ্রামীণ) ভরতলাল মিনা বলেন “মহিলার পরিবারের পক্ষ অভিযোগ পেলে পুরো বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে।” আপাতত একটি অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা রুজু করেছে পুলিশ। নার্সিংহোমের অন্যতম মালিক মুক্তেশ দে বলেন, “আমাদের এখানে বধূটির চিকিৎসা শুরু করতে দেরি হয়েছে বলে যে অভিযোগ তোলা হচ্ছে তা ঠিক নয়। ঘটনায় নার্সিংহোমের কেউ জড়িত নন।” তাঁর সংযোজন, “নার্সিংহোমের ছাদের চার দিকে চার ফুট উঁচু পাঁচিল দেওয়া রয়েছে। কী ভাবে এই কাণ্ড ঘটল, আমরাও বুঝে উঠতে পারছি না!” |