চিকিৎসকদের নিয়ে মানবসমাজ সংশয়াকুল এরা বন্ধু না শত্রু, এদের বিশ্বাস করা উচিত না সন্দেহ? এই অনিশ্চিতিকে আরও উস্কে দেওয়ার জন্য এসেছে নতুন দাবি -চিকিৎসকদের ওষুধ লিখতে হবে জেনেরিক নামে, ব্র্যান্ড নামে নয়। ব্যাপারটা বোঝা দরকার। আপনি বাজারে গেছেন চাল কিনতে। খোলা বস্তা থেকে চাল কিনতে পারেন। আবার বড় কোম্পানির ছাপ-মারা প্যাকেটের চালও কিনতে পারেন। খোলা চালের দাম কম, গুণগত মান নির্দিষ্ট নয়। অন্য দিকে, ছাপ-মারা চালের দাম বেশি। গুণগত মান সুনিশ্চিত এবং তা না-হলে আপনি ক্রেতাসুরক্ষা আদালতে যেতে পারেন।
ওষুধের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। কিন্তু তফাতও অনেকখানি। চাল আপনি নিজের পছন্দে কিনবেন এবং তার দায়িত্বও পুরোপুরি আপনার। কিন্তু ওষুধের ক্ষেত্রে আপনার যেমন স্বাধীনতা নেই, তেমনই দায়িত্বও নেই। ওষুধের নাম যখন চিকিৎসক লিখে দিচ্ছেন, তখন তার ভাল-খারাপের দায়িত্বও চিকিৎসকের। এই জায়গা থেকেই এই বিতর্ককে বুঝতে হবে।
সন্দেহের জায়গা হচ্ছে, যে হেতু চিকিৎসক ঠিক করবেন তিনি একটি ওষুধের কোন নামটা লিখবেন, কাজেই সেই বিশেষ ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থা সেই চিকিৎসককে প্রভাবিত করতে পারে নিজেদের ওষুধ লেখাবার জন্য। এবং তার ফলে চিকিৎসক নিজের স্বার্থে রোগীর কথা না-ভেবে কমদামি ওষুধের বদলে বেশি দামের ওষুধ লিখবেন। জেনেরিক নামে ওষুধ লেখা বাধ্যতামূলক হলে চিকিৎসকের এই অসৎ অভিপ্রায় সিদ্ধ হবে না। |
যে নামে ডাকো? ‘ব্র্যান্ডেড’ না ‘জেনেরিক’ ওষুধ? |
তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যাক, সবাই না-হলেও কিছু চিকিৎসক এই অসদুপায় অবলম্বন করেন। তা হলে কি এই প্রথা বন্ধ করার উপায় জেনেরিক নামে ওষুধ লেখা? উত্তরটা একটা বিরাট ‘না’। যুক্তি দিয়ে ব্যাপারটা বোঝা যাক। বেশির ভাগ ওষুধই ভারতে জেনেরিক নামে বাজারে পাওয়া যায় না। বড়-ছোট, ভাল-মন্দ বিভিন্ন প্রস্তুতকারক সংস্থার বিশেষ নামেই তা বাজারে পাওয়া যায়। এখন চিকিৎসক যদি জেনেরিক নামে ওষুধ লিখে দেন, তখন ক্রেতা ওষুধের দোকানে গিয়ে কী কিনবেন? ক্রেতা কী কিনবেন তা ঠিক করে দেবেন সেই ওষুধের দোকানের কর্মচারী। ওষুধ কোম্পানিগুলির চোখ পড়বে তাঁদের ওপর। এ বার ভাবুন, চিকিৎসক অসৎ হলেও তাঁকে প্রেসক্রিপশন লিখে সই করতে হচ্ছে সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে। তাঁর মাথার উপর অনেক খাঁড়া ঝুলছে এম সি আই, স্বাস্থ্য দফতর, ক্রেতাসুরক্ষা আদালত। আর ওষুধের দোকানের যে কর্মচারীটি ক্রেতাকে নিজের পছন্দের ওষুধ বিক্রি করলেন তার নামই তো ক্রেতা জানবেন না, সই করা কাগজ তো দূরের কথা।
ব্যাপারটা তলিয়ে ভাবুন তো। অনেক ওষুধ বাজারে পাওয়া যায় যেগুলো দুই বা বেশি ওষুধের সংমিশ্রণ। সারা পৃথিবীতে এদের কার্যকারিতা স্বীকৃত। এতে ওষুধের দাম কম হয়, খাওয়ার সুবিধা হয় এবং ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনাও কম থাকে। এই ওষুধ আপনি জেনেরিক নামে লিখবেন কী করে? আর লিখলেই বা ওষুধের দোকানের লোক তা বুঝবে কী করে? একটা সহজ পরীক্ষা। প্রায় সবার বাড়িতেই জেলুসিল বা ডাইজিন ট্যাবলেট আছে। দেখুন তো, তাতে কী কী যৌগ কত কত পরিমাণে আছে। ওই তালিকা কোনও চিকিৎসকের পক্ষে লেখা সম্ভব! এ বার নিজে ওই নামগুলি লিখে যে-কোনও ওষুধের দোকানে গিয়ে ওষুধটা চান তো। যদি একটা জেলুসিলের বড়ি নিয়ে ফিরতে পারেন তো জানাবেন! আরও দুঃসাহসিক হলে বিকোসুল ক্যাপসুল নিয়ে এই পরীক্ষা করুন। আরও একটু এগিয়ে ভাবুন। ধরুন, আপনি উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। চিকিৎসক জেনেরিক নামেই ওষুধ লিখবেন। কিন্তু অন্তত পঞ্চাশ রকম ওষুধ আছে এর জন্য। চিকিৎসক কোনটা পছন্দ করবেন সেটা কিন্তু জেনেরিক ওষুধ তৈরির সংস্থা দ্বারাও প্রভাবিত হতে পারে। কারণ, জেনেরিক ওষুধও আকাশ থেকে পড়ে না। কোনও না কোনও কোম্পানিই সেগুলো বানায়।
বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, যদি সঙ্গতি থাকে তা হলে আপনি খোলা বাজারের তেল কিনবেন, না কি কোনও নামী কোম্পানির সিলমোহর করা টিনের তেল কিনবেন? তা হলে যাঁরা কিনতে পারেন, তাঁদের জন্য নাম-করা ওষুধ লিখতে ডাক্তারকে বাধা দেওয়া হবে কোন যুক্তিতে? সরকার যত দিন ব্র্যান্ডেড ওষুধ বাজারে চালু রাখবে, তত দিন ডাক্তারদেরও স্বাধীনতা থাকা উচিত ব্র্যান্ড পছন্দ করার। নতুবা সরকার ব্র্যান্ড উঠিয়ে দিক, সব ওষুধই বাজারে আসুক জেনেরিক নামে। সমান্তরাল ধারা যদি চলে তবে অবশ্যই রোগী জেনেরিক নাম চাইলে ডাক্তারের উচিত সেই নামেই ওষুধ লেখা, কিন্তু কোনও মতেই একে রোগী এবং ডাক্তারের জন্য বাধ্যতামূলক করা উচিত নয়।
সবশেষে ধরে নেওয়া গেল, ডাক্তার জেনেরিক নামে ওষুধ লিখে দিয়েছেন। এ বার ক্রেতার পূর্ণ স্বাধীনতা নিজের পছন্দের ব্র্যান্ড বা জেনেরিক কেনার। ব্র্যান্ডের নামগুলো ক্রেতা কোথায় পাবেন? তা হলে বাধ্যতামূলক হোক ভারতের সমস্ত ওষুধের দোকানে সব ওষুধের সব ব্র্যান্ডের (সংখ্যাটা কম করে ২০০×২০) নাম ও মূল্যতালিকা ঝুলিয়ে রাখা। অসুখ তো সারার আগেই বেড়ে যাবে!
ক্ষত হলে তা সারাবার চেষ্টা থাকা উচিত। ক্ষতটি অন্য জায়গায় সরিয়ে দিয়ে লাভ নেই। চিকিৎসকদের বলব, আরও সচেতন ভাবে এবং বিবেক সহকারে চিকিৎসা করতে, যাতে এই ধরনের অহেতুক সন্দেহ সৃষ্টি না হয়।
ডা. সৌমিত্র রায়। কলকাতা-১৯ |