জমি স্বভাবত সীমিত। এমনকী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ক্রমে ক্রমে এই সত্যটির মহিমা উপলব্ধি করিতেছেন। জমি কেবল শিল্প স্থাপনের জন্য আবশ্যক হয় না, সমাধিস্থল গড়িতেও জমির প্রয়োজন হয়। সাধারণ মানুষের কথা ধর্তব্য নহে, কিন্তু এ ভবমণ্ডলে কেহ কেহ বেশি সমান। এ দেশে তাঁহারা ‘ভি আই পি’ নামে খ্যাত। রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর মতো উচ্চতম কোটিতে যাঁহারা উত্তীর্ণ হন, তাঁহাদের তকমার আগে একটি বাড়তি ‘ভি’ যুক্ত হয়। এই অতি অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা দিল্লির দরবারি কর্তাদের চিন্তায় ফেলিয়াছেন। স্থান সঙ্কুলানের চিন্তা। জীবনে নয়, জীবনের পরে। মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর সমাধিস্থল রাজঘাট হইতে শুরু করিয়া গত সাড়ে ছয় দশকে বিবিধ ভি ভি আই পি নলিনীদলগত জলের অনুসরণে বিদায় লইয়াছেন। নশ্বর দেহ বিদায় লইলেও বিশিষ্ট ব্যক্তিগণের মহিমা বিদায় লয় না, অ্যালিস-এর গল্পের চেশায়ার মার্জারের হাসিটির মতোই ভাসিয়া থাকে। নিরালম্ব বায়ুভূত অবস্থায় তাহাকে ভাসাইয়া রাখিতে পারিলে গোল ছিল না, মানুষের মনের মণিকোঠা নামে পরিচিত কোনও দিকশূন্যপুরে সেই মহিমা উল্লম্ব হইয়া থাকিলেও ভারি চমৎকার হইত। কিন্তু, হে ভারত ভুলিও না, কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল এক বিন্দু নয়নের জলটির জন্য সব মিলাইয়া বিপুল পরিমাণ জমির প্রয়োজন হইয়াছিল। সেই শাহজাহানও নাই, সেই যমুনাও নাই। যমুনা-পারের নির্ধারিত এলাকায় নূতন নূতন সমাধিস্থল গড়িয়া নূতন নূতন ভি ভি আই পি-র জন্য মরণোত্তর স্থান সঙ্কুলান করা ক্রমশই দুরূহ হইয়া উঠিতেছে। শূন্যস্থান পূরণের পরিবেশ তথা বাস্তু সংক্রান্ত কুফলগুলি ক্রমশ স্পষ্ট হইতেছে বলিয়া সমস্যা আরও গভীর। সমাধান?
উত্তর, এক অর্থে, সহজ। জাগরণের প্রভাব যেমন নিদ্রায় ও স্বপ্নে, জীবনের ছায়া তেমনই জীবনের পরেও প্রলম্বিত হয়। রাজধানীতে বিশিষ্ট জনদের স্থানাভাব জীবন হইতেই মরণোত্তর পর্বে প্রসারিত হইতেছে। দিল্লি কলিকাতা নয়, মুম্বইও নয়, দিল্লি শহর হিসাবে বিলক্ষণ সুপরিসর। কিন্তু ভি আই পি-দের বিপুল হইতে বিপুলতর বর্গটির চাহিদার সামাল দিতে গিয়া সেই প্রশস্ত রাজধানীও হার মানিতেছে। প্রথমত, সরকারের আয়তন এ দেশে ক্রমবর্ধমান। আর্থিক সংস্কারের দুই দশকেও সরকারি কর্তাদের সংখ্যা ও প্রতিপত্তি কমাইতে ব্যর্থ হইয়াছে। তদুপরি, ভি ভি আই পি-দের ক্ষেত্রে বাড়তি সমস্যার কারণ ভূতপূর্বদের প্রভূত মহিমা। তাঁহারা অনেকেই দেবতাবিশেষ। তাঁহারা বিদায় লইলে তাঁহাদের বাড়ি সংগ্রহশালায় পরিণত হয়, উত্তরসূরিদের জন্য নূতন বাড়ি খুঁজিতে হয়। অধুনা এই আতিশয্য কিছু কমিয়াছে, দেবতার সংখ্যা হ্রাস পাইবার ফলেই নিশ্চয়। ইংল্যান্ডে দশ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট প্রধানমন্ত্রীর কালজয়ী ঠিকানা, ভারতে ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রীগণের বাড়িগুলি ঘুরিতে রীতিমতো সময় লাগিবে। সংখ্যার নিয়মেই এক সময় এই রীতিতে কিছুটা রাশ টানিতে বাধ্য হইয়াছে সরকার। সমাধিস্থলের জন্য নূতন চিন্তাভাবনাতেও সেই সংখ্যার চাপই সক্রিয়। বাস্তব পরিস্থিতির তাড়নায় মানসিকতা বদলাইতে পারে, বদলায়। বিশিষ্ট রাজপুরুষদের প্রয়াণের পরে তাঁহাদের সম্মান জানাইবার অনেক সদুপায় আছে, শহরের মধ্যে এবং উপকণ্ঠে ক্রমাগত সমাধিস্থল গড়িয়া সীমিত জমি এবং মুক্ত পরিবেশের ক্ষতি সাধন করিয়াই সম্মান জানাইতে হইবে, ইহা শুভবুদ্ধি নহে। বাস্তববুদ্ধিও নহে। অতি গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও নেত্রীরা যদি স্পষ্ট ভাষায় নিজেদের মরণোত্তর স্মৃতিরক্ষার সদুপায় সম্পর্কে নির্দেশ দিতে পারেন, দিল্লির উপকার হইবে, যমুনারও। তাহা না হইলে একদিন গোটা রাজধানী শহরটি স্মৃতিসৌধে পরিণত হইবে। ভাল হইবে কি? |