বাঙালি সমাজে শেয়ার এখন আর আগের মতো অস্পৃশ্য নয়।
পুরনো বাংলা ছায়াছবিতে শেয়ারে টাকা খাটিয়ে সর্বস্বান্ত হওয়ার ঘটনা দেখানো যেন একটি রেওয়াজ ছিল। অবস্থা পাল্টেছে। বেশির ভাগ মানুষ এখন ঝুঁকি বুঝে শেয়ারে লগ্নির পথে নামেন। অর্থাৎ সর্বস্বান্ত হওয়ার সম্ভাবনা এখন অনেক কম। পাশাপাশি এটাও ঠিক, ইক্যুইটি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা বহু লগ্নিকারীরই নেই। নতুনদের সুবিধার জন্য আজ আমাদের আলোচ্য বিষয় ইক্যুইটির অতীত ও বর্তমান।
ব্যবসার আদিম যুগে সবই ছিল একমালিকি কারবার। ব্যবসা বাড়তে শুরু করলে বোঝা গেল, একজনের পক্ষে মূলধন জোগানো এবং ব্যবসা সামলানো বেশ কঠিন। ফলে শুরু হল অংশীদারি কারবার। একই অসুবিধা আবার দেখা দিল, যখন অতি বড় হয়ে উঠল ব্যবসার আকার। বোঝা গেল, বড় শিল্প গড়তে গেলে যে-বিরাট মূলধনের প্রয়োজন, তা মাত্র কয়েক জন অংশীদারের পক্ষে জোগানো সম্ভব নয়। পরিচালনার জন্য দরকার পেশাদারি হাত।
এটাও মানুষ বুঝতে শিখল, বেশি মানুষকে ব্যবসায় আকৃষ্ট করতে হলে তাঁদের ব্যবসা সংক্রান্ত দায়ের বোঝা একটি সীমার মধ্যে রাখতে হবে। এই চিন্তা-ভাবনা থেকেই জন্ম নিল লিমিটেড লায়াবিলিটি কোম্পানি, যেখানে মূলধন জোগানদাতার দায় তাঁর মূলধনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। কোম্পানির লোকসান হলে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তি নিয়ে টানাটানি করা হবে না। এই শর্তে অনেক মানুষ এগিয়ে আসতে শুরু করলেন জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে লগ্নি করতে।
এই ভাবে বহু মানুষের থেকে টাকা সংগ্রহ করে সংস্থার যে-তহবিল গড়ে ওঠে, তাকে শেয়ার মূলধন বা শেয়ার ক্যাপিটাল নাম দেওয়া হল। এই মূলধনের এক-একটি অংশকে বলা হল শেয়ার। যেমন একটি সংস্থার মোট মূলধন যদি হয় ১ কোটি টাকা এবং তা যদি ১০ লক্ষ ভাগে ভাগ করা যায়, তবে প্রতিটি শেয়ারের দাম হবে ১০ টাকা যাকে আমরা এখন বলি ফেস ভ্যালু। ১০ হাজার মানুষ ১০০টি করে শেয়ার কিনে এই মূলধনের জোগান দিতে পারেন। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে প্রত্যেকের লগ্নি হবে মাত্র ১০০০ টাকা। এঁদের দায় সীমাবদ্ধ থাকবে ওই ১০০০ টাকার মধ্যেই। এ ভাবে অনেকে মিলে গড়ে তুলতে পারেন বড় মাপের সংস্থা। ভারতে এখন অনেক সংস্থা আছে, যাদের সদস্য সংখ্যা ১ লক্ষ থেকে শুরু করে ২০ লক্ষ পর্যন্ত। বড় শিল্প গড়তে হলে এ ছাড়া পথ নেই।
কোম্পানির লাভ হলে তার একাংশ সদস্যদের মধ্যে তাঁদের শেয়ারের অনুপাতে ভাগ করে দেওয়া হয়, যার প্রচলিত নাম ডিভিডেন্ড। ডিভিডেন্ডের যেহেতু নিশ্চয়তা নেই, সেই কারণে মানুষ শুধু ডিভিডেন্ডের আশায় লগ্নি করেন না। তাঁরা চান শেয়ারের দামও বেড়ে উঠুক। দাম বাড়ার জন্য একটি বাজারের প্রয়োজন। শেয়ার বিক্রি করে লগ্নির টাকা ফেরত পাওয়ার জন্যও চাই সংগঠিত বাজার। এ সব তাগিদ থেকেই জন্ম নেয় শেয়ার বাজার। ভারতে শেয়ার বাজার স্থাপিত হয়েছে একশো বছরেরও আগে। এ দেশে মূল বাজার দুটি। মুম্বই স্টক এক্সচেঞ্জ এবং ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ। যে শ্রেণির শেয়ার আমরা বাজারে দৈনিক কেনাবেচা হতে দেখি, তা হল ইক্যুইটি শেয়ার। এ ছাড়া আছে প্রেফারেন্স শেয়ার। এর তেমন একটা প্রচলন নেই। এই কারণে আজকের আলোচনা শুধু ইক্যুইটি শেয়ার নিয়েই।
শেয়ারে লগ্নি করলে পরোক্ষ ভাবে শিল্প এবং দেশকে সাহায্য করা হয়। একটি প্রকল্প স্থাপনে যদি ১০০ কোটি টাকার তহবিল দরকার হয়, তবে তার কমপক্ষে ২৫ কোটি আসতে হবে ইক্যুইটির পথে। বাকি ৭৫ কোটি ঋণ বাবদ সংগ্রহ করা যেতে পারে। ঋণ-শেয়ারের এই অনুপাতের প্রচলিত নাম ডেট ইক্যুইটি রেশিও। ভারী শিল্পে ইক্যুইটির অনুপাত আরও বেশি।
বাজার চাঙ্গা থাকলে নতুন প্রকল্পের শেয়ার বিক্রি করতে সুবিধা হয়। এতে শিল্পোন্নয়ন গতি পায়। অর্থাৎ অর্থনীতির স্বার্থে শেয়ার বাজার তেজী থাকা জরুরি। চাঙ্গা বাজারে এক দিনের লেনদেন ১ লক্ষ কোটি টাকা ছাড়াতে পারে। এতে সরকারের রাজস্ব বাড়ে। সুযোগ হয় কর্মসংস্থানের।
নতুন ইস্যুর সময়ে শেয়ার সরাসরি কোম্পানি থেকে কেনা যেতে পারে। এ ছাড়া ব্রোকারের মাধ্যমে কেনা যেতে পারে শেয়ার বাজার থেকে। বাজারে নথিবদ্ধ বা লিস্টেড শেয়ার কেনার জন্য লগ্নিকারীর ডি-ম্যাট অ্যাকাউন্ট জরুরি।
ফেস ভ্যালুর থেকে বেশি দামে শেয়ার ইস্যু হলে অতিরিক্ত যে মূল্য দেওয়া হয়, তার নাম প্রিমিয়াম। শেয়ারের ফেস ভ্যালু ১০০, ১০, ৫, ২ এবং ১ টাকা হতে পারে। একটি সংস্থা প্রথম বার শেয়ার ইস্যুর পর আবার ইস্যু ছাড়লে, তা অনেক সময়েই কোম্পানি সদস্যদের আগে কেনার সুযোগ দেওয়া হয়। এর নাম রাইট শেয়ার। নিয়মিত ডিভিডেন্ড দেওয়ার পরেও যখন একটি সংস্থার খাতায় উদ্বৃত্ত জমে উঠতে থাকে, তখন সংশ্লিষ্ট কোম্পানি চাইলে সেই উদ্বৃত্তের (রিজার্ভ) একাংশ ব্যবহার করে সদস্যদের মধ্যে বিনামূল্যে নতুন শেয়ার বণ্টনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এর নাম বোনাস শেয়ার।
শেয়ারের ডিভিডেন্ড পুরোপুরি করমুক্ত। শেয়ার কেনার পর এক বছর বা তার বেশি সময় ধরে রেখে তা বিক্রি করে লাভ হলে তার উপর কর বসে না। আগে বিক্রি করলে ১৫% মূলধনী লাভকর দিতে হয়। ইক্যুইটির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বিভিন্ন মিউচুয়াল ফান্ড শেয়ার বাজারের মাধ্যমে ইক্যুইটিতে লগ্নি করে। সুতরাং আপনি যখন এ ধরনের মিউচুয়াল প্রকল্পে লগ্নি করেন, তখন পরোক্ষ ভাবে ইক্যুইটিতেই লগ্নি করেন। সেই কারণে বাজারজনিত লাভের সম্ভাবনা এবং ঝুঁকি দুই-ই আপনাকে নিতে হয়। |