একই ইলিশ। কিন্তু কলকাতার দু’প্রান্তে তার দাম দু’রকম। আর এই নিয়েই রবিবার বেধে গেল উত্তর আর দক্ষিণ কলকাতার সেই চিরন্তন কাজিয়া।
মানিকতলার বিধায়ক পরেশ পালের ইলিশ উৎসব চলছিল কাঁকুড়গাছিতে। সেখানেই বিতর্কটা উস্কে দেন উত্তর কলকাতার তৃণমূল সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। রান্না করা বড়সড় একটি ইলিশের পেটি ছুরি দিয়ে সামান্য কেটে মুখে তুলে মাইক হাতে নেন সুদীপবাবু। বলেন, “উত্তর কলকাতায় ইলিশ ১২০০ টাকা কেজি। আর দক্ষিণে ৯০০। একই শহরের দু’জায়গায় দামের ফারাক ৩০০ টাকা!”
সুদীপবাবুর পাশেই বসে ছিলেন রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। ইলিশের আসরে দু’চার কথা বলতে উঠে পার্থবাবু উত্তর বনাম দক্ষিণের রেশ টেনে বলেন, “দক্ষিণে ‘তিনি’ থাকেন। তাই বাজার হয়তো আপনা-আপনিই নিয়ন্ত্রিত হয়।” ‘তিনি’ বলতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বোঝাতে চান পার্থবাবু। শিল্পমন্ত্রী একই সঙ্গে জানিয়ে দেন, ‘তিনি’ চান, বাংলার সর্বত্রই জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে থাকুক। |
ইলিশ নিয়ে উত্তর-দক্ষিণের লড়াইটাকে অবশ্য ‘উপভোগ্য’ পর্যায়ে তুলে নিয়ে যান দক্ষিণের বাসিন্দা পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। বিতর্কে নেমে তাঁর টিপ্পনী, “আসলে দক্ষিণের বাসিন্দারা উত্তরের তুলনায় গরিব তো! তাই আমাদের ওখানে দামও কিছুটা কম।”
ইলিশের দাম নিয়ে শহরের দু’প্রান্তের এই লড়াইয়ে টিপ্পনী কাটতে ছাড়েননি অনেকেই। যেমন অভিনেতা খরাজ মুখোপাধ্যায়। নেতাদের চাপান-উতোরের কথা শুনে দক্ষিণের বাসিন্দা খরাজের বক্তব্য, “আমিও তো কিছু দিন আগে ১২০০ টাকা কেজি দরে দু’টি ইলিশ কিনেছি।” তা হলে দামের বাজারে উত্তরের ‘কৌলীন্য’ থাকল কোথায়?
ইলিশের দাম নিয়ে উত্তর-দক্ষিণ কাজিয়া যে রীতিমতো ‘সুস্বাদু’, ইলিশ উৎসবে যোগ দেওয়া সকলেই সেটা বিলক্ষণ টের পেয়েছেন। এই কাজিয়ার মোড়কটা না-হয় মজার। কিন্তু ইলিশের মূল্য-ভেদের প্রকৃত ছবিটা কেমন?
বাঙালি রান্নার অন্যতম জনপ্রিয় একটি রেস্তোরাঁর মালিক বাবলু সাহার কথায়, “আমরা পাইকারি বাজারে ৮০০ টাকা কেজি দরে ইলিশ কিনি। সেই একই ইলিশের দাম এক-এক জায়গায় এক-এক রকম হাঁকছেন খুচরো ব্যবসায়ীরা।” তাঁর মতে, মানিকতলা বা গড়িয়াহাট থেকে যাঁরা ইলিশ কেনেন, তাঁদের ইলিশের দাম সম্পর্কে বিশেষ ধারণা নেই। তাই খুচরো বিক্রেতারা তাঁদের যেমন খুশি বুঝিয়ে দিচ্ছেন।
অন্য একটি নামী রেস্তোরাঁর অন্যতম মালিক রাজীব নিয়োগীর মতে, উত্তর ও দক্ষিণ কলকাতার খুচরো বাজারে ইলিশের দাম এলাকার চাহিদার উপরে নির্ভর করে। হয়তো উত্তরে চাহিদা বেশি বলে সেখানকার বিক্রেতারা দাম কিছুটা বাড়িয়ে রেখেছেন। দক্ষিণে চাহিদা হয়তো কম। তাঁর কথায়, “হাওড়া ও শিয়ালদহ, এই দুই পাইকারি বাজারে ইলিশের দাম এখন ৭৫০ থেকে ৮৫০ টাকা কিলোগ্রামের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। এ বার আষাঢ়-শ্রাবণ, দু’মাসে এ দেশের ইলিশের জোগান নেই। তাই বাংলাদেশের ইলিশই ভরসা। স্থানীয় বাজারে বিক্রেতারা নিজের নিজের মতো দাম চাইছেন সেই ইলিশের।”
তা হলে কি শহরের দু’প্রান্তে দু’রকম দাম চলতেই থাকবে?
মাছ ব্যবসায়ীদের মতে, বাজারে ইলিশের জোগান বাড়লেই এই ফারাক ঘুচে যাবে। তবে তার জন্য দরকার বাংলাদেশ থেকে ইলিশ রফতানির উপরে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার। ঢাকা ওই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে সমস্যার অনেকটাই সমাধান হবে বলে মনে করছেন তাঁরা।
বাংলাদেশি নিষেধাজ্ঞা উঠবে কি?
এ দিনের ইলিশ উৎসবে নিমন্ত্রিতদের তালিকায় ছিলেন বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার আবিদা ইসলাম। তিনি আশার কথা শুনিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, রমজানের জন্য চলতি মাসে বাংলাদেশ সরকার ভারতে ইলিশের রফতানি নিষিদ্ধ করেছে। তবে আগামী মাস থেকেই পদ্মার ইলিশ ফের ঢুকবে ভারতে।
আপাতত সেই আশাতেই রসনা সংযত রাখতে হবে কলকাতার উত্তর-দক্ষিণের ঘটি-বাঙালদের! |