প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ ও কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী দু’জনেই মনে করছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে এ বার পশ্চিমবঙ্গকে বিশেষ আর্থিক সাহায্য দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক। সনিয়া সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে এ ব্যাপারে রাজনৈতিক সুপারিশ করেছেন। মনমোহনও এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমের সঙ্গে কথা বলেছেন। এক প্রশ্নের জবাবে চিদম্বরম বলেন, “পশ্চিমবঙ্গ সরকার যে আর্থিক দাবিদাওয়া তুলছে, সেটি অযৌক্তিক, তা আমি কখনওই বলি না। রাজ্যওয়াড়ি পরিস্থিতি দেখে বিষয়টি বিচার করতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে প্রস্তুত। আশা করি, আলোচনার মাধ্যমে চলতি জটিলতার ফাঁস থেকে মুক্ত হতে পারব।”
সনিয়া মনে করছেন, আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে মমতার সঙ্গে সম্পর্ক আরও ভাল করা প্রয়োজন। ২০১৪ সালে কংগ্রেসের মূল প্রতিপক্ষ হল বিজেপি। সেখানে মমতার মতো এক গুরুত্বপূর্ণ শরিককে চটানো বা অহেতুক শত্রু করা যে কাজের কথা নয়, তা এখন কংগ্রেসের শীর্ষ নেতাদের বোঝাচ্ছেন সনিয়া। ওই নেতারাও মনে করছেন, শরদ পওয়ার বা করুণানিধির দলে এত দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে যে, তাদের নিয়ন্ত্রণ করা সোজা। এমনকী সমর্থক মুলায়ম-মায়াবতীর ক্ষেত্রেও কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা যায়। কিন্তু মমতাকে ঠিক সেই রাস্তায় বাগে আনা সম্ভব নয়। তাই পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে মমতার যে দাবিদাওয়া, সেগুলির প্রতি সুবিচার করাটা জরুরি।
কংগ্রেস নেতাদের সনিয়া জানিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম-কে মমতার নেতৃত্বেই হারানো সম্ভব হয়েছে। রাজ্য কংগ্রেসের সামনে সেই সুযোগ থাকলেও তারা তা হেলায় হারিয়েছে। এখনও রাজ্যে তৃণমূলের তুলনায় কংগ্রেস যথেষ্ট দুর্বল। আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে মমতার ভাল ফল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এই অবস্থায় ২০১৪-র আগে বিজেপি তথা এনডিএ যাতে মমতাকে কাছে টেনে ইউপিএ-তে ভাঙন ধরাতে না পারে, তাই ‘অতিসক্রিয়’ হয়েছেন সনিয়া।
এই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী মমতার সঙ্গে নতুন করে আলাপ-আলোচনা শুরু করতে চাইছেন। সেই জন্য মমতাকে দিল্লি আসার জন্য বারবার অনুরোধ জানানো হয়েছে। মমতা দিল্লিকে জানিয়েছেন, ঈদ পর্যন্ত নানা কর্মসূচিতে তিনি ব্যস্ত। ২১ অগস্টের পরে তিনি দিল্লি আসার চেষ্টা করবেন। এ দিকে প্রধানমন্ত্রী আবার ২৮ অগস্ট ‘ন্যাম’-এর বৈঠকে যোগ দিতে তিন দিনের জন্য ইরানে যাবেন। তাই ২১ থেকে ২৭-এর মধ্যে মমতা দিল্লি আসুন, এটাই চাইছেন মনমোহন।
এক প্রশ্নের জবাবে মমতা বলেন, “আমরা হলাম ঘর পোড়া গরু। এক বার কেন, দিল্লির সঙ্গে আমি একশো বার আলোচনায় বসতে রাজি। কিন্তু দিল্লিকে বুঝতে হবে যে, আমরা ভিক্ষে চাইছি না। কোনও ব্যক্তিগত দলগত প্রাপ্তির আশায় দাবি-দাওয়া জানাচ্ছি না। যা চাইছি, তা পশ্চিমবঙ্গের মানুষের স্বার্থে।”
মমতার মতে, চৌত্রিশ বছরের বাম জমানায় পশ্চিমবঙ্গে যে চূড়ান্ত আর্থিক নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছিল, তা কেন্দ্রের অজানা নয়। তাঁর দাবি, কেন্দ্রে যখন সিপিএমের বন্ধু বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহের সরকার ছিল, তখন যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান ছিলেন মধু দণ্ডবতে। তিনিও বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক হাল শোচনীয়। নরসিংহ রাওয়ের আমলে প্রণব মুখোপাধ্যায় যখন যোজনা কমিশনের দায়িত্ব নেন, তখনও তিনি এক রিপোর্টে জানিয়েছিলেন যে, এক টাকার মধ্যে ৯৩ পয়সা যোজনা বহির্ভূত খাতে খরচ হয়ে যায়, আর সাত পয়সায় রাজ্যে উন্নয়ন হয়।
এই পরিস্থিতিতে মমতার প্রশ্ন, “কেন্দ্র এ সব জানা সত্ত্বেও যখন বামফ্রন্ট সরকারকে আর্থিক শৃঙ্খলার শিক্ষা দেয়নি, তখন আজ তাদের সেই ঋণের সুদের বোঝা আমাদের কেন বইতে হবে? কেন সেটা মকুব করার প্রশ্ন তুললে আমাদের আর্থিক শৃঙ্খলার কথা বলা হচ্ছে? সে দিন প্রত্যেক মাসে কেন্দ্র পশ্চিমবঙ্গকে ওভারড্রাফ্টে টাকা দিয়েছে। তখন তো কেন্দ্র যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা বা অন্য রাজ্যের কথা ভাবেনি!”
প্রণববাবু যখন অর্থমন্ত্রী ছিলেন, তখনই রাজ্যের আর্থিক দাবিদাওয়া নিয়ে অমিত মিত্রকে মমতা বেশ কয়েক বার দিল্লি পাঠিয়েছিলেন। সে সময়ে অর্থ কমিশন তাদের রিপোর্টে জানিয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গ, পঞ্জাব ও কেরল সব থেকে ঋণগ্রস্ত রাজ্য। তিন রাজ্যের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি আরও জটিল। কেন না ওই রাজ্যে দীর্ঘ দিন ধরে কোনও বিনিয়োগ আসেনি। প্রণববাবু তৎকালীন ব্যয়সচিব সুমিত বসুর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেছিলেন। সেই কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি হওয়ার ঠিক আগে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকার একটি আর্থিক প্যাকেজ তৈরি করেছিলেন প্রণববাবু। কিন্তু ঋণের সুদ ও আসল পরিশোদের ক্ষেত্রে তিন বছরের জন্য ছাড় না পেলে ওই প্রস্তাবে রাজি নয় বলে জানিয়েছিল রাজ্য সরকার। রাজ্যের তরফে অমিতবাবু যুক্তি দিয়েছিলেন, রাজস্ব হিসেবে রাজ্য যে টাকা সংগ্রহ করছে, তার থেকে বেশি টাকা সুদ বাবদ খরচ হয়ে যাচ্ছে। তখন কেন্দ্রের পক্ষ থেকে অমিতবাবুকে বোঝানো হয়, ঋণের বোঝা সব রাজ্যের থাকে। বরং প্রণববাবু অর্থ কমিশনকে পরামর্শ দিয়েছেন, যাতে কোনও ভাবেই রাজ্যকে চাপ না দেওয়া হয়। কিন্তু পাল্টা যুক্তিতে রাজ্য জানায়, সুদ মকুব না করলে রাজ্যকে তো সেই সুদ দিতেই হবে। তার পরিবর্তে যদি তিন বছর সুদ দেওয়া বন্ধ থাকে, তা হলে যে টাকা বাঁচবে, তা রাজ্যের অর্থনীতিতেই লগ্নি করা হবে। এতে রাজ্যের অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। এবং ভবিষ্যতে রাজ্যের পক্ষ থেকে কেন্দ্রকে অর্থ ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে। রাজ্য-কেন্দ্র এই চাপানউতোরের মাঝেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন এগিয়ে আসে। রাষ্ট্রপতি মনোনয়নকে কেন্দ্র করে তৈরি সমস্যা মেটার পরে এখন প্রণববাবু ও মমতার সম্পর্ক ফের ভাল হয়েছে। দিল্লি এলে তাঁর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন মমতা। আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর প্রণববাবুর কলকাতা যাওয়ার কথা। মমতা প্রস্তাব দিয়েছেন, ওই দিনই রাজ্য সরকারের তরফে প্রণববাবুকে সংবর্ধনা দেওয়া হোক। দু’পক্ষের মধ্যে যখন সম্পর্কের উন্নতি ঘটছে, তখন প্রণববাবুও চাইছেন, আর্থিক প্যাকেজ সংক্রান্ত সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান হোক।
|