বাড়িতে ডাকাতির পরে ‘কে, কোথায় আছ’ বলে আর্তস্বরে পড়শিদের ডাকাডাকি করেছিলেন তরুণী বধূটি। গয়নাগাটি খোয়া গিয়েছে বলে ইনিয়ে-বিনিয়ে কান্নাও জুড়েছিলেন।
সে দিনের সেই ‘সন্ত্রস্ত’ তরুণী নিজেই যে তাঁর শ্বশুরবাড়িতে লুঠের ছক কষেছিলেন, ঘটনার মাসখানেক বাদে সে কথা বুঝতে পেরে তাজ্জব বনে গিয়েছে পুলিশ। পেশাদার লুঠেরাদের কাজে লাগিয়ে শ্বশুরবাড়িতে ডাকাতি করানোর অভিযোগে শনিবার সকালে নিউ টাউন থানা এলাকায় জ্যাংড়া শীতলাতলার জয়সোয়াল পরিবারের ছোট বউ সুমনকে গ্রেফতার করেছে তারা। গ্রেফতার হয়েছে তাঁর দুই ভাইও।
গত ১৪ জুলাই সন্ধ্যায় লুঠপাটের সময় জয়সোয়ালদের বাড়িতে ছিলেন দুই জা পুষ্পা ও সুমন। ছিল সুমনের দুই শিশুকন্যাও। এ দিন পুলিশ সুমনকে ধরার পরে তাঁর বড় জা পুষ্পার মন্তব্য, “এত দিন এক সঙ্গে থেকেও ঘরের শত্রু বিভীষণকে চিনতে পারিনি!”
পাঁচ বছর আগে জয়সোয়ালদের ছোট ছেলে সুভাষের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে সুমনের। ২৬ বছরের তরুণীর চার ও দেড় বছরের দু’টি মেয়ে। তিনি হঠাৎ ‘ঘরের শত্রু’ হতে যাবেন কেন?
পুলিশ সূত্রের খবর, ওই তরুণী শ্বশুরবাড়ির লোকেদের বিরুদ্ধে ‘দুর্ব্যবহারের’ অভিযোগ করেছেন। কিন্তু এই কারণটুকুই যথেষ্ট বলে মনে করছেন না তদন্তকারীরা। স্ত্রী ধরা পড়ার পর থেকে সুভাষ নিখোঁজ। বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার বলেন, “সুভাষকেও আমরা সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখছি না।” |
সুভাষ একটি দোকানে ছোটখাটো কাজ করেন। তাঁর দাদা কৃপাশঙ্করের লোহা-লক্কড়ের ব্যবসা। তদন্তকারীদের একাংশের অভিমত, লুঠের পিছনে দু’ভাইয়ের মধ্যে আর্থিক অবস্থায় ফারাক একটা বড় কারণ। পুষ্পাও বলছেন, “সংসারে টাকা-পয়সা দেওয়া নিয়ে আমার স্বামী ও দেওরের মধ্যে খিটিমিটি লাগত।”
তবে দু’ভাইয়ের মধ্যে ‘অশান্তি’র বাইরে এই লুঠের পিছনে অন্য কারণ আছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখছে পুলিশ। কেন না, শুধু সুমন বা সুমনের স্বামীই নন। অভিযুক্তদের মধ্যে সুমনের দুই ভাই, শিবকুমার সাউ ও রাজকুমার সাউও রয়েছেন। সুমনের শ্বশুরবাড়িতে না-ঢুকলেও লুঠের সময়ে দুই ভাই কাছেই অপেক্ষা করছিলেন বলে পুলিশের দাবি। ‘মামা’ ও ‘গোরা’ নামে দু’জন দাগি দুষ্কৃতীর সঙ্গে যোগসাজশে তারা এই লুঠ করে বলে তদন্তে জানা গিয়েছে।
লুঠ-রহস্য জানা গেল কী ভাবে?
বন্দর এলাকার রবীন্দ্রনগর-সন্তোষপুরে শুক্রবার রাতে নিজামুদ্দিন ওরফে গোরা নামে এক দুষ্কৃতী ধরা পড়ে। পুলিশি সূত্রের খবর, গোরাকে জেরা করার সময়ই জ্যাংড়ার ডাকাতির ঘটনায় তার যোগাযোগের কথা জানা যায়। সুমনদের ‘পরামর্শেই’ সে ওই ডাকাতি করে বলে দাবি করে গোরা। তার পর শুক্রবার রাত থেকে অভিযান চালিয়ে ধরা হয় বাকি অভিযুক্তদের।
কী ঘটেছিল ১৪ জুলাই সন্ধ্যায়?
পুষ্পা জানান, তাঁর দুই ছেলে-মেয়ে তখন পড়তে গিয়েছিল। কলিং বেল বাজতে তিনিই দরজা খুলে দেন। তাঁকে ধাক্কা মেরে চার জন লুঠেরা ঘরে ঢোকে। পুষ্পার কথায়, “আমার বুকে ছুরি ঠেকিয়ে লুঠেরারা যা আছে দিয়ে দিতে বলে। গলা থেকে হার ছিঁড়ে নেয়।” তাঁর গয়নাগাটি লুঠ হয়েছে বলে পুলিশের সামনে কান্নাকাটি করেছিলেন সুমনও। পুলিশকে বলেছিলেন, কোলের দুই বাচ্চা সঙ্গে ছিল বলে তিনি দুষ্কৃতীদের বাধা দেননি।
জয়সোয়ালদের এক পড়শি জয়দেব ঘোষ ওই সন্ধ্যায় চিৎকার শুনে তাঁদের বাড়িতে গিয়েছিলেন। শনিবার তিনি বলেন, “সুমনের ব্যবহারে সে দিন আমাদেরও একটু খটকা লেগেছিল। পুষ্পাকে সঙ্গে নিয়ে আমরা, পাড়ার লোকেরাই থানায় খবর দিতে যাই। তখন সিঁড়ির কাছে একটি লাল ব্যাগ পড়েছিল। ফিরে এসে দেখি সেটা গায়েব।” তবে জয়দেববাবুর বক্তব্য, “সুমনই যে এই লুঠে জড়িত, সেটা ভাবতে পারিনি।” পুলিশ সূত্রের খবর, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের সময়ও সুমনের কথায় কিছু অসঙ্গতি ছিল। তবে তখন তাঁর বিরুদ্ধে নিশ্চিত প্রমাণ মেলেনি। এ দিন সকালে জ্যাংড়ার হেলাবটতলায় সুমনের বাপের বাড়িতে গিয়ে তাঁকে ধরে পুলিশ।
ডিসি (বন্দর) মেহবুব রহমান জানান, ধৃতদের মধ্যে রয়েছে, নিজামুদ্দিন ওরফে গোরা ছাড়াও রয়েছে সঞ্জয়কুমার বাল্মিকী ওরফে মামা ও মহম্মদ আনোয়ার নামে তিন দুষ্কৃতী। মামা সদ্য জেল খেটে বেরিয়েছে। লুঠ হওয়া মোবাইল ফোন এবং গয়নার একাংশ উদ্ধার করা হয়েছে। লুঠ-করা গয়না কেনার অভিযোগে সন্তোষ সাউ নামে বউবাজারের এক গয়না ব্যবসায়ীকেও গ্রেফতার করা হয়।
এই ডাকাতির সঙ্গে জড়িত আরও কয়েক জনের খোঁজে তল্লাশি চলছে। তবে সুমনের সঙ্গে ছোট দুই বাচ্চা থাকায়, তাঁকে একটানা বেশি ক্ষণ জেরা করা সম্ভব হচ্ছে না বলে পুলিশ জানিয়েছে। |