|
|
|
|
|
ইলিশ,তুমি যেখানেই থাকো
সত্বর ফিরিয়া আইস, খিচুড়ি তোমার জন্য অপেক্ষা করিতেছে।
যা দিনকাল পড়েছে, ইলিশ প্রায় নস্টালজিয়া।
অঞ্জন চট্টোপাধ্যায় |
|
|
অতীত বড় মধুর। বড় মধুর সব স্মৃতি। স্মৃতিতে সর্ষে ইলিশ। পদ্মা-গঙ্গা একাকার। কোলাঘাট থেকে মাওয়াঘাট। রুপোলি শস্যের প্রেমে সোনালি সে সব দিন। হতে হবে এমন, খাওয়ার পরেও হাতে থেকে যাবে তার সুবাস। দেড় কিলোর কম হলে শিল্পের অপমান। সব অপমান সইব, ইলিশ নিয়ে ইয়ার্কি, কভি নেহি!
সব গল্পেরই একটা শুরু থাকে। আর গল্প যখন, তার সমাপ্তিও অবশ্যম্ভাবী। তা, ইলিশ যে এ ভাবে গল্প হয়ে যাবে এক দিন, আমার হাতে লেখা হবে ইলিশের অবিচুয়ারি, ভাবিনি, ভাবতে পারিনি। জীবন থেকে জীবন চলে গেলে যতটা কষ্ট, ইহকাল থেকে ইলিশ চলে যাওয়া তো প্রায় তাই! খবরের কাগজ খুলুন, টিভির চ্যানেলেও এই শোক কে-ই বা গোপন রাখতে পেরেছেন? যে বাঙালবাড়িতে, মোহনবাগান জোড়া গোল খেলে জোড়া ইলিশ ঢুকত, বাড়ির বড়দের কাছে এর পর ছোটরা শুনবে সেই গল্প। গল্প ভাপা ইলিশ, ভর্তা, মুইঠ্যা বা পাড়াজাগানো গন্ধে সাড়া তোলা সেই ম ম করা স্মৃতি। মানিকতলা বাজারের ইলিশ মার্চেন্ট বাবলু দাসের মুখেও সেই গল্প। ‘যেটুকু জোগান স্যার, পদ্মাপার থেকেই আসছে, বাংলাদেশই এখন ধরে রেখেছে পশ্চিমবাংলার হেঁসেল। তাও ওজনে মেরেকেটে আটশো। কোথায় যে হারিয়ে গেল কিলো কিলো ইলিশের দিন, এখন বললে, স্রেফ গল্প বলে মনে হয়!’ বাঙালির জীবন থেকে অনেক কিছুই হারিয়ে যাচ্ছে। নবতম, এই ইলিশ। অতীত হয়ে যাওয়া এই বিষয়, বাঙালি যাকে আদর করে বলে নস্ট্যালজিয়া। আর, খেয়াল করে দেখবেন, বাঙালিই বলে, বাঙালিরাই নাকি বড় নস্ট্যালজিক। জীবনানন্দ যেমন ফিরতে চেয়েছিলেন ধানসিঁড়িটির তীরে, বাবলুদা ফিরতে চান বড় জোর বছর দশেক আগে। ‘আজ যদি হঠাৎ করে ২০০ কিলোর একটা বরাত পাই, দু’বার ভাবতে হয়, অর্ডারটা নেব কী নেব না! দশ বছর আগেও, এই জুলাই মাসের শেষে দাঁড়িয়ে কিন্তু সেই নিয়ে ভাবতে হত না।’ |
|
অলঙ্করণ: দেবাশীষ দেব |
ভাবতে হচ্ছে এই অধম পেটুককেও। পাতে ইলিশ না থাকলে, বাঙালি আর কী নিয়ে বলবে, ওহ! কলকাতা...আর কী এমন স্বাদ যা ভোলাবে ইলিশের এই অনুপস্থিতি। বাঙালির জীবনে এখন যেমন বৃষ্টি নেই, ফিস্টিও নেই। এই ছিঁটেফোঁটা বর্ষাতে এখন খিচুড়ি একা। ইলিশ, তুমি যেখানেই থাকো, সত্বর বাংলায় ফিরিয়া আইস, তোমার প্রাণের বন্ধু খিচুড়ি তোমার জন্য অপেক্ষা করিতেছে। আচ্ছা, বাংলাদেশের কী সিন, সেখানেও কি এমনই ইলিশবিহীন দিন? ফোনে বন্ধু লুকোলেন না মনের কথা। হা-পিত্যেশ, সীমান্তের ওপারেও চলছে, চলবে! খোকা ইলিশ ধরা নিয়ে সে দেশেও জারি হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। এই ক্যাচ দেম ইয়ং ব্যাপারটি ইলিশের ক্ষেত্রে রীতিমতো অপরাধ। ছোট ইলিশ ধরলে যেমন পরে বড় ইলিশের জোগানে টান পড়ে, তেমনই ইলিশের বংশবিস্তারও যায় থমকে। পলি জমে গঙ্গার গভীরতা কমে যাওয়া, ইলিশের আমদানির পথে এক বড় বাধা। ৫০০ গ্রামের কম ওজনের ইলিশ ধরা, কেনা বা বেচা এখন তাই সঙ্গত কারণেই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ইলিশ নিয়ে গল্পের শেষ নেই। টেনুয়ালোসা ইলিশা নিয়ে সৈয়দ মুজতবা আলির পঞ্চতন্ত্রে অনেক গল্প। তার নামও নানা। পার্সিরা যাকে ডাকে বিম, গুজরাতিরা মদার, আমরা তাকেই ভালবেসে বলি ইলিশ। স্বাস্থ্যগুণেও লা-জবাব এই মৎস্যরাজ। ব্রেন বা নার্ভ-এর জন্য ইলিশ খুবই উপকারী। এমনকী, হার্টের পক্ষেও ভাল। যে কোনও মাছের মতোই নিয়মিত ও পরিমিত ইলিশসেবনে চোখও ভাল থাকে।
গুণাগুণের কথা যাক। দোষের কথায় ফিরি। আর দোষ তো একটাই। ইলিশ-লোভ। যে লোভের শিকার হননি, এমন বঙ্গসন্তান বিরল। এ এক ধরনের ফাঁদ, যাতে শুধু বাঙালিরাই নন, অবাঙালি, এমনকী অভারতীয়রাও ধরা দিয়েছেন যুগ যুগ ধরে। এমন এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমস্টারডাম এয়ারপোর্ট-এ, যাঁর সঙ্গে আলাপের সূত্রপাতই ইলিশের পাত ধরে। লাউঞ্জে বসে, সবে আমার লাঞ্চ বক্সটা একটু ফাঁক করেছি, কোথা থেকে উড়ে এসে সেই সাহেব আমার সামনে হাজির। ‘স্মেলিং হিলসা?’ বাঙালির জিভে জল গড়াতে অনেক দেখেছি, সাহেবরাও যে তাতে কম যায় না, সে দিন বুঝেছিলাম। তো, ইলিশ-লোভ সীমানা মানে না। যে খায়নি, বা খায় না, সে ঠিকঠাক রক্তমাংসের মানুষ কি না, আমার সন্দেহ হয়!
গল্প ফুরোয়, ফুরোয় না ইলিশের গল্প। এক বার শুরু হলে, তার শেষ নেই। মুড়ো থেকে ল্যাজা,
কিছুই যায় না ফেলা। ইলিশের গল্পের মহিমা এমনই। যেখানেই কামড়, সেখানেই চমক। আর সবচেয়ে বড় চমক, বাঙালির পাত থেকে তার নিরুদ্দেশ-যাত্রায়। আমরা কত কিছুর জন্যই তো প্রার্থনা করি। বৃষ্টির জন্য, নতুন কিছু সৃষ্টির জন্য। আসুন, সমবেত হয়ে ডাকি সেই মীনদেবতাকে। বলি ‘আয় হিলসা ঝেঁপে, বরষা দেব মেপে...’ |
|
|
|
|
|