অলিম্পিকে মেরি কমের হার দেখে আমার সেই ছাত্রীর কথা মনে হচ্ছে, যে মুখস্থ করে আসা প্রশ্নের উত্তরগুলো পরীক্ষা-হলের প্রশ্নপত্রে না পেয়ে ফেল করে যায়!
নিকোলা অ্যাডামস এর আগে কয়েক বার মেরির বিরুদ্ধে লড়েছে। নিকোলাকে যত বার রিংয়ে দেখেছি বেশিরভাগ সময় ডিফেন্স দিয়ে শুরু করে। মেরি তাই ধরে নিয়েছিল শুরুতেই আক্রমণে যাবে। কিন্তু সেই স্ট্র্যাটেজি কোনও কাজেই লাগল না। দেখলাম নিকোলা ডিফেন্সের বদলে ‘অ্যাটাকিং’ দিয়ে শুরু করল। মেরিও সেই রাস্তায় হাঁটতে গেল। আর তাতেই শুরুতে হকচকিয়ে গেল আমাদের মেয়ে। সেই শুরু। তার পর আরও যে তিন রাউন্ড লড়াই হল, সব ক’টাতেই কিন্তু নিকোলা স্ট্র্যাটেজি বদল করেছে।
শুধু আমি নই, সারা দেশ একটা সোনার জন্য তাকিয়ে ছিল মেরির দিকে। কিন্তু সেটা এল না। আমরা যাঁরা বক্সিং রিংয়ে নামি সবাই জানি, কোনও কোনও দিন ‘ব্যাড ডে’ যায়। বুধবার মেরির তেমনই দিন গেল। যে দিন কোনও কিছুই আপনার ঠিকঠাক হবে না। তবে নিকোলা জিতলেও মেরিকে উড়িয়ে দিতে পারেনি। বক্সিংয়ে একটা ব্যাপার খুব চালু আছে ‘আলি শাফ্ল’। রিংয়ে মহম্মদ আলির পায়ের ছন্দ থেকে যে শব্দটার তুমুল জনপ্রিয়তা। রিংয়ে লড়াইয়ের সময় পায়ের মুভমেন্টটা খুব বড় ব্যাপার। মানে ঠিক সময় পিছিয়ে আসা, এগিয়ে যাওয়া। প্রায় নাচের মুদ্রায়। এ রকম করতে করতেই বিপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বিধ্বংসী পাঞ্চ। কোয়ার্টার ফাইনালে তিউনিসিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে যেটা আগের ম্যাচে করেছিল মেরি। ‘আলি শাফ্ল’ বলতে ঠিক যা বোঝায়, সেটা নিকোলার বক্সিংয়ে আছে। অসম্ভব ভাল ফুটওয়ার্ক ওর। নিকোলা এ দিন সারা ম্যাচে ‘আলি শাফ্ল’ ব্যবহার না করলেও শেষ রাউন্ডের একেবারে শেষ সেকেন্ডে তার কাছ থেকে ‘আলি শাফ্ল’ কিন্তু দেখা গেছে। অন্য দিকে একশো কুড়ি কোটি ভারতবাসীর প্রত্যাশার চাপ হোক বা অন্য কিছুর জন্য মেরির পাঞ্চগুলো কাজে লাগেনি। ‘স্কোর ব্লো’ করা যাকে বলে সেটা হয়নি। বিপক্ষের গ্লাভস এড়িয়ে ঘুসিগুলো ঠিক মতো ল্যান্ড করেনি। ফলে পুরো পয়েন্ট ওঠেনি। শুধু তাই নয়, ‘ফেইন্ট অ্যাটাক’ যাকে বলে অর্থাৎ প্রথমে ঘুসিটা মারার ভান করে এক পা এগিয়ে ‘ফল্স’ দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে পরের ঘুসিটা অপ্রত্যাশিত ভাবে মারা-- এটাও করতে পারেনি মেরি। নিকোলা কিন্তু সেটা করেই কিছু পয়েন্ট তুলে নিয়েছে।
পাঁচ বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন মেরি। আমি খিদিরপুরের একটা অবৈজ্ঞানিক রিংয়ে অনুশীলন করে কমনওয়েলথ সোনা-সহ প্রচুর পদক জিতেছি। মেরি তার চেয়েও খারাপ মণিপুরের এক অজ পাড়া গাঁয়ের একটা রিং থেকে উঠে এসেছে। ওকে আড়াল করতে চাইছি না। বারবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়ে ও একটা প্রত্যাশা তৈরি করেছিল। টেকনিক্যালি মেরি কিন্তু অলিম্পিকে প্রথম থেকেই পিছিয়ে ছিল। কেন? মেরি বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ৪৬ কেজি বা ৪৮ কেজির লাইট ফ্লাইওয়েটে। মেয়েদের বক্সিংয়ে এ বারই অলিম্পিকে প্রথম। মাত্র তিনটে বিভাগ রাখা হয়েছে। ৫১ কেজি, ৬০ এবং ৭০ কেজি। মেরি নেমেছিল ৫১ কেজিতে। অর্থাৎ ওকে ওজন বাড়াতে হয়েছে। এতে যে কোনও বক্সারের শক্তি কমে যায়। সমস্যা হয়। তার ওপর নিকোলার উচ্চতা ছিল বেশি। যা খবর পেয়েছি তাতে নিকোলা কিন্তু ওজন কমিয়ে নেমেছে। বক্সিংয়ের যারা খোঁজখবর রাখেন তারা জানেন, এতে শক্তি অনেক বেড়ে যায়। নিকোলার স্টেপিং-ও বেশ ভাল ছিল। প্রত্যেকটা পাঞ্চ ঠিক জায়গায় পড়েছে।
মেরির জন্য খারাপ লাগছে। কিন্তু এটাই রিং-জগতের ট্র্যাজেডি। তবে গর্বও হচ্ছে। চরম প্রতিকূলতা সত্ত্বেও জীবনের প্রথম অলিম্পিক থেকেই ব্রোঞ্জ পদকটা মেরি কিন্তু জিতে নিয়ে আসছে দেশের জন্য। সেটাই বা কম কীসের? এ দেশে মেয়েদের বক্সিংয়ের ছবিটাই এর পরে বদলে যাবে। |