চতুর্থ রাউন্ডের শেষে ১১-৬।
শ্মশানের স্তব্ধতা নেমে এল গেমস ভিলেজের ঘরটায়। যেন ব্রোঞ্জ পদকটা কোনও পদকই হতে পারে না। যেন কিনে রাখা আতসবাজি, বিলোনোর জন্য রাখা মিষ্টি সব অর্থহীন। কেউ ভেঙে পড়লেন কান্নায়। কেউ ছুটে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।
যতক্ষণ খেলা চলেছে, মেরি কমের যমজ সন্তান রেচুংভার ও খুপনেইভার একটি বারের জন্যও টিভির দিকে তাকায়নি। ওরা খুটখাট করতে ব্যস্ত ছিল মোবাইল নিয়ে। মেরির পরাজয়ে নেমে আসা বিষণ্ণতার মধ্যেও কে যেন ওদের কানে কানে বললেন, “মা এ বার ফিরে আসবে।” ওই একটা কথাতেই আলো জ্বলে উঠল মুখে।
মেরির কোয়ার্টার ফাইনাল গ্রামের বাড়িতে বসেই দেখেছিলেন বাবা টংপা। সেমিফাইনাল দেখতে তিনি হাজির হয়েছিলেন ইম্ফলের বাড়িতে। সকাল থেকেই প্রার্থনা চলছিল। সমবেত কণ্ঠে পরিবারের সকলে, ছাত্রছাত্রীরা সবাই যিশুর কাছে মেরির জয় ভিক্ষে চাইছিলেন।
সওয়া ছ’টা বাজতেই পিন পড়ার স্তব্ধতা। পরপর পেরিয়ে গেল তিনটে রাউন্ড। ১-৩, ২-৫, ৪-৮। স্তব্ধতা স্তব্ধতর হল। আশা নেই বুঝে তৃতীয় রাউন্ডেই মুখ চেপে বসেছিলেন টংপা, নিকোলাস, হানি, টোনি, গ্লোরিয়া, ডেভিডরা। ফাইনাল রাউন্ডে ১১-৬। মেরি কম হেরে গেলেন। সেই সঙ্গে যেন সর্বস্বান্ত হল মণিপুরও। |
সেমিফাইনালের দৌড়ে তখন পিছিয়ে পড়েছেন মেরি কম। ইম্ফলের চূড়াচাঁদপুরের
কাংথেই কম গ্রামে মেরির বাড়ির টিভির সামনে তাই উদ্বিগ্ন মুখের ভিড়। কিন্তু মায়ের
খেলা দেখায় মন নেই দুই ছেলে রেচুংভার ও খুপনেইভারের। তারা ব্যস্ত
মোবাইল নিয়ে খেলতে। বুধবার রাজীবাক্ষ রক্ষিতের তোলা ছবি। |
এই বার রাজ্য থেকে মোট পাঁচ জন অলিম্পিকে গিয়েছিলেন। তিন জন আগেই বিদায় নিয়েছেন। চতুর্থ জনের উপরে সোনা বা নিদেনপক্ষে রুপোর প্রত্যাশা এতটাই ছিল যে, ভিন রাজ্যে অলিম্পিকে ব্রোঞ্জজয়ীর জন্য যেমন উৎসব হয়, তার কিছুই হল না ইম্ফলে। খালি জুয়াড়িদের পোয়াবারো। রাজ্যে মেরির লড়াই নিয়ে লক্ষ-লক্ষ টাকা বাজি ধরা হয়েছিল যে! যুদ্ধ শেষে হতাশ টংপা বললেন, “মনকে সান্ত্বনা দিতে পারছি না। জানি, সারা বিশ্বে তৃতীয় হওয়াটাও যথেষ্ট কৃতিত্বের। তবু ফাইনালে না ওঠার দুঃখটা কাটানো কঠিন। প্রত্যাশার চাপটা খুব বেড়ে গিয়েছিল।”
এই প্রত্যাশার চাপই কি কাল হল? না কি প্রযুক্তিগত ত্রুটিই এই হারের জন্য দায়ী?
মেরির প্রথম কোচ ইবোমচা। তাঁর আর এক ছাত্র তথা মণিপুরের পঞ্চম প্রতিনিধি দেবেন্দ্রও এ দিন কোয়ার্টার ফাইনালে হেরে বিদায় নিয়েছেন। ইবোমচা স্যার কিন্তু দোষ দিচ্ছেন মেরির ‘হেড গিয়ার’কে। তিনি বলেন, “প্রথম দিন থেকে দেখছি, মেরির হেড গিয়ারটা আলগা। লড়াইয়ের সময় এত বার ‘হেড গিয়ার’ ঠিক করতে গেলে মনোযোগ সরে যেতে বাধ্য। এ তো পাড়ার খেলা নয় যে অন্যের ‘হেড গিয়ার’ মাথায় চাপিয়ে লড়তে হচ্ছে! অলিম্পিকে ‘হেড গিয়ার’ নিয়ে বারবার সমস্যা হবে কেন?” ফোন করবেন না মেরিকে? আজ নয়। আজকের দিনটা মেরিকে মেরির মতো ছেড়ে দেওয়ার পক্ষপাতী তিনি। আগামী কাল মেরিকে ফোন করবেন ইবোমচা। “সবার উপরে ভাগ্য। এ বারের প্রতিদ্বন্দ্বী অনেক শক্তিশালী ছিল। মেরি চেষ্টা করেছে। ব্রোঞ্জটা কি কম কথা?”
মেরির পরিবার আর পড়শিদের কে বোঝাবে এ কথা? তার মধ্যেই লাঙ্গোল গেমস ভিলেজে আছড়ে পড়া সংবাদমাধ্যম খেলার শেষে ইচ্ছে মতো কথা বসাচ্ছে মেরির বাবা-সন্তানদের মুখে। তুখোড় হিন্দি, ইংরেজির ফোয়ারার মধ্যে মেরির পরিবারের আবেগ বারোয়ারি হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। যে যা জানতে চাইছেন, অসহায়ের মতো মাথা নাড়াচ্ছেন বাবা। ভেংচি কেটে দিচ্ছে রেচুংভার ও খুপনেইভার।
বিরক্ত গলায় মেরির পড়শি বলছিলেন, “চাষির ঘরে জন্মানো ব্রোঞ্জজয়ী মেয়ের পরিবারকে নিয়ে ‘পিপ্লি লাইভ’ খেলাটাও আজ শেষ হল।” এ বার তাই টিআরপি-র দৌড় থেকে বহু দূরে আফস্পা-এনকাউন্টার-অবরোধের শহরে আবার ফিরতে চলেছে ইম্ফল। |