অলিম্পিক ব্রোঞ্জকে ঘষেমেজে সোনা-রুপোয় বদলাতে পারেননি তিনি। পারেননি ঘরের মাঠের প্রবল সমর্থনপুষ্ট প্রতিদ্বন্দ্বীর চ্যালেঞ্জ টপকাতে।
কিন্তু তাতে কি সত্যিই কিছু এল-গেল?
তিনিই তো আসমুদ্রহিমাচলকে বুধবারের ভরসন্ধেতেও যেন সূর্যালোক দেখালেন! গোটা দেশ কুর্নিশ জানাল তিরিশ ছুঁইছুঁই এক কুকি মহিলাকে। যিনি সন্ত্রাসবিধ্বস্ত, দারিদ্রক্লিষ্ট, আর্থ-সামাজিক দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এক পার্বত্য রাজ্য থেকে স্বপ্নের উড়ানে চড়ে ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’-এ সোনালি দাগ রাখলেন। শেষ লড়াইয়ে হেরেও যিনি দেশবাসীর চোখে জয়ী, কারণ নিছক বক্সিং রিংয়ে আবদ্ধ না থেকে তিনি আজ সামাজিক উত্তরণের এক বিশাল কাহিনি ‘ম্যাগনিফিসেন্ট মেরি’।
সনিয়া গাঁধী থেকে কপিল দেব। সচিন তেন্ডুলকর থেকে অক্ষয়কুমার। টিভিতে চোখ রাখা রাজনীতি-বলিউড-ক্রীড়াজগৎ সব একাকার হয়ে গিয়েছিল আজ, যখন ভারতীয় সময় সন্ধে সাড়ে ছ’টা নাগাদ লন্ডনের এক্সেল এরিনায় ২০১২ অলিম্পিকে মেয়েদের বক্সিংয়ের ৫১ কেজি বিভাগের দ্বিতীয় সেমিফাইনালে নামছিলেন মেরি কম।
রিংয়ে ঢোকার কয়েক ঘণ্টা আগে স্বয়ং মেরি টুইট করেছিলেন, ‘লড়াইয়ের জন্য আমি তৈরি। আমাকে যাঁরা শুভেচ্ছা জানিয়েছেন তাঁদের সবাইকে ধন্যবাদ। আশা করি দেশকে গর্বিত করতে পারব। জয় হিন্দ।’ আর হারের পর গোটা ভারতের মতো টেমসের তীরে তিনিও হতাশ। অলিম্পিক অভিষেকেই ব্রোঞ্জ পদক নিয়ে ফিরছেন, সেই গর্বও তখন তাঁর উধাও। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “আমি দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাইছি রুপো বা সোনা জিততে পারলাম না বলে।” এবং এই মন্তব্যের পরে যমজ সন্তানের জননী মেরি কম গোটা দেশের চোখে আর শুধু নিছক চ্যাম্পিয়ন বক্সার নন, এক মহীয়সী। |
পরাজয়ের পরে। ছবি: উৎপল সরকার। |
না হলে অক্ষয়কুমার কেন টুইট করবেন ‘যদি তোমার মতো বক্সিং করতে পারতাম! ব্রোঞ্জ জিতেও ক্ষমা চাওয়াটা তো সোনা জেতারই সমান...।’ সেই টুইটারেই তাঁকে নিয়ে আবেগ চাপতে পারেননি সচিন তেন্ডুলকর এবং অমিতাভ বচ্চন। সচিন লিখছেন ‘মেরি কম এক অত্যাশ্চর্য মহিলা। দেশের জন্য পদক জিততে কী অবিস্মরণীয় যুদ্ধই না করলেন! রিংয়ের ভেতর-বাইরে, দু’জায়গাতেই। আমরা সবাই ওঁর জন্য গর্বিত।’ আর অমিতাভ? তাঁর উপলব্ধি ‘আজই সকালে মেরির সঙ্গে ফোনে কথা বলার সৌভাগ্য হল। কী অসাধারণ মহিলা! তুমি গোটা দেশকে গর্বিত করেছ। তুমি শুধু চ্যাম্পিয়নই নও, তোমাকে সবাই ভালবাসে, সম্মান করে।’
ব্রিটিশ বক্সার নিকোলা অ্যাডামসের কাছে ৬-১১ পয়েন্টে এ দিন হেরে যান মেরি। তার পর প্রকৃত খেলোয়াড়ের মতোই প্রতিপক্ষের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নিয়ে প্রাক্তন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ভারতীয় বলেন, “অ্যাডামস দারুণ চালাক। মূলত কাউন্টার-পাঞ্চার। কিন্তু যেটাই মারে তাতে ভয়ঙ্কর জোর থাকে। যে কারণে ট্যাকটিক্যালি দারুণ কিছু না হয়েও খুব কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বী। ব্রোঞ্জ জেতার চেয়েও আমি আরও ভাল পারফরম্যান্স করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু স্টেডিয়ামে নিজের দেশের তুমুল সমর্থনের জোরে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী আরও অনেক বেশি ভাল লড়ল।”
সত্যিই। ঘরের মেয়ে অ্যাডামসের জন্য গোটা গ্যালারি তো ছিলই। এবং সেই বিশাল সমর্থককুলের মধ্যে এক জন খোদ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন! দর্শকাসনে ছিলেন পাক বংশোদ্ভূত ব্রিটেনের সুপারস্টার বক্সার আমির খানও। প্রাক্তন রুপোজয়ী অলিম্পিয়ান আমির এখন পেশাদার বক্সিং সার্কিটে চলে যাওয়ায় লন্ডন গেমসে নামেননি। ভারতীয় বক্সারের বিরুদ্ধে গলা ফাটাতে গ্যালারিতে হাজির পাক-জাত বক্সার! ভারত-পাক কূটনৈতিক সমীকরণের নিরিখেও ব্যাপারটা রোমাঞ্চকর! এই যখন আবহ, তখন লড়াই শেষে সাধাসিধে মেরি বলছিলেন, “খেলাধুলোতে হারজিত আছেই। তা ছাড়া আমি এ দিন কিছু ভুলও করেছি। ভুল অবশ্য মানুষমাত্রেরই হয়। তবে এই ভুলগুলো না করলে আজ আমিই জিততাম।”
দু’মিনিটের এক-একটা রাউন্ড। চার রাউন্ডের লড়াই। মেরির সমবয়সীই বছর উনত্রিশের নিকোলাকে বক্সিং সার্কিটে লোকে বলে ‘বেবিফেস’ তাঁর কিশোরীসুলভ মুখের জন্য। বক্সারের কাঠিন্য সেখানে বিন্দুমাত্র নেই। কিন্তু রিংয়ের ভেতর প্রচণ্ড আক্রমণাত্মক, ক্ষুরধার, দ্রুত। মেরির চেয়ে ইঞ্চি তিনেকের বেশি লম্বা হয়তো নন, কিন্তু নিকোলার ঘুসির জোর এবং আওতা, দুটোই এ দিন দেখা গেল অনেকটাই বেশি। শেষ রাউন্ড শুরু হওয়ার আগে মেরি চার পয়েন্টে পিছিয়ে পড়েন। নিকোলাকে নক-আউট করা ছাড়া তখন ফাইনালে ওঠার অন্য রাস্তা কার্যত নেই মেরির সামনে। গ্যালারি কিন্তু তখনই ঘরের মেয়ে নিকোলার নামে জয়ধ্বনি দেওয়া শুরু করে দিয়েছে।
শেষ রাউন্ডে মরিয়া লড়লেন মেরি। কিন্তু ২ পয়েন্টের বেশি এল না।
কিন্তু তাতে কি সত্যিই কিছু এল-গেল?
যমজ সন্তানের জননী এক কুকি মহিলা যে ততক্ষণে ভারতের খেলাধুলোর ইতিহাসে নিজের নাম লিখে ফেলেছেন। ভুল বলা হল। আসলে ভারতীয় সমাজজীবনের ইতিহাসেই নাম লিখে ফেলেছেন মেরি কম!
|
মেরি কেন হারলেন |
নিকোলা কেন জিতলেন |
• যে ক্যাটিগরিতে (৪৮ কেজি) মেরি
পাঁচ বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, তা অলিম্পিকে নেই।
ওজন বাড়িয়ে ৫১ কেজিতে নামতে হয়। |
• শেষ লগ্নে দেখা গিয়েছিল ‘আলি শাফ্ল’ বা
মহম্মদ আলির ঢঙে নাচের ছন্দে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ।
আর আগাগোড়াই চমকপ্রদ ফুটওয়ার্ক। |
• নিকোলা বিশ্বের দু’নম্বর, মেরি চার। বড় অঘটন
ছাড়া মেরির জেতা স্বাভাবিক ভাবেই কঠিন ছিল।
শেষ লড়াইয়েও হারতে হয় মেরিকে। |
• নিকোলার (৫৫) উচ্চতা মেরির (৫২) চেয়ে বেশি।
প্রকৃতিগত কারণেই বাড়তি সুবিধা।
হাত লম্বা এবং ‘হ্যান্ড স্পিড’ও ভাল। |
• রিংয়ের মধ্যে স্টেপিংয়ে
নমনীয়তার অভাব, যা ভুগিয়েছে।
অধিকাংশ পাঞ্চ অল্পের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট। |
• বিপুল জনসমর্থন। নিকোলার প্রতিটি পাঞ্চে
দর্শক গলা ফাটিয়েছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী
ডেভিড ক্যামেরনও দর্শকাসনে। |
• প্রতি রাউন্ডেই ঠিকঠাক প্রথম পাঞ্চ নিকোলার।
যা মানসিক ভাবে মেরিকে পিছিয়ে দেয়। |
• দীর্ঘদিনের পুরনো পিঠের ব্যথা
সারিয়ে একশো শতাংশ ফিট। |
|