প্রতি শ্রাবণে ফিরে আসে সেই রাত। নবদ্বীপের মানুষের কাছে আর এক কোজাগরীর রজনী। জন্মাষ্টমী বা কৃষ্ণ কোজাগরী।
দেবতা এ রাতে প্রিয় হয়ে ওঠেন। ভক্তেরা এই রাতে তাঁকে দেবতাজনিত সমীহ, দূরত্বে অর্চনা করেন না। স্নেহের স্পর্শে তাঁরা ছুঁতে চান মহাকাব্যের এক নায়ককে। বৃষ্টি মাখা যে রাতে যে নায়ক জন্মলগ্নে আশ্রয়চ্যুত হয়েছিলেন, মহাকাব্য জুড়ে যিনি পরে আশ্রয় হয়ে উঠেছিলেন এক জনপদের ইতিহাসের। কৃষ্ণের জীবন ঘিরে গড়ে উঠেছে কীর্তনের যে বিরাট সম্ভার, তার চর্চা করেন নিভৃতে অনেকে। এই সব দিনে নবদ্বীপে কান পাতলে শোনা যায় সেই সব পদ।
ক’দিন আগের ঝুলন উৎসবেই বাঁধা হয়ে যায় জন্মাষ্টমীর সুর। বর্ষার ফুল জুঁই ভরে যায় অঙ্গনে। চন্দন, কস্তুরী, অগুরুর গন্ধে এলোমেলো বাতাস তখন বহন করে মহাজন পদ। শ্রাবণ নিশীথে অষ্টমী তিথি যখন রোহিনী নক্ষত্রে প্রবেশ করে তখনই শুরু হয় মহাভিষেক। মধ্য রাতের স্তব্ধতা ভেঙে খানখান করে বেজে ওঠে অগণিত শাঁক, করতাল, মৃদঙ্গ। উচ্চকিত সঙ্কীর্তনের শব্দ নাট মন্দির থেকে গৃহস্থের ঘরে পৌঁছে যায় সেই বার্তা নিয়ে, জন্ম নিলেন এক দেবশিশু। বৃন্দাবন থেকে নবদ্বীপ, মথুরা থেকে মায়াপুরউৎসব এক। কিন্তু উদ্যাপনের ধরন অন্যরকম। ধামেশ্বর মহাপ্রভুর মন্দিরে বিষ্ণুপ্রিয়াসেবিত মহাপ্রভুর দারু বিগ্রহকে শ্রীকৃষ্ণ মনে করে জন্মাষ্টমীর উৎসব পালিত হয়। প্রাচীন রীতি মেনে এখানে শ্রীকৃষ্ণের বদলে মহাভিষেক হয় মহাপ্রভুর। কিন্তু দারুবিগ্রহকে স্নান করানো তো সম্ভব নয়, তাই জগন্নাথ মিশ্র সেবিত শালগ্রাম শিলা রাজরাজেশ্বরকেই প্রতিনিধি স্বরূপ মহাস্নান করানো হয়। নতুন পোশাক পরেন মহাপ্রভুও। রাধারমণবাগ সমাজবাড়িতে বিশুদ্ধ বৃন্দাবনী ঘরানায় পালিত হয় জন্মাষ্টমী। রাগানুরাগা মার্গের কৃষ্ণ ভজনে বিশ্বাসী সমাজবাড়ির সেবাইতেরা কৃষ্ণকে তাঁদের বড় প্রিয় ভাবেন। তাই প্রিয় বালকের জন্মদিন যে ভাবে পালন করা হয়, সেই ভাবেই পালন করা হয় জন্মাষ্টমী। একই ভাবে নবদ্বীপের হরিসভা মন্দির, চৈতন্য জন্মস্থান আশ্রম, চৈতন্য সারস্বত মঠের মতো দেড়শোর বেশি মন্দিরেও সাড়ম্বরে পালিত হয় এই উৎসব।
জলঙ্গী নদীর পাড়ে রেউই নামের এক গ্রামে সতেরো শতকে গড়ে উঠেছিল নদিয়া রাজের রাজধানী। রেউই ছিল মূলত গোপ সম্প্রদায়ের গ্রাম। কৃষ্ণ জন্মাষ্টমীর রাতে এই গোপেদের গ্রামেই আশ্রয় পেয়েছিলেন। সেই সূত্রেই রেউইয়ের নাম কৃষ্ণনগর করা হয় বলে অনেকে মনে করেন। সেই শহরে যশোদার কোলে ছোট্ট কৃষ্ণএই মূর্তি তৈরি করে পুজো করা হত। এখনও শহরের প্রাণকেন্দ্র ডাকঘর মোড় থেকে কদমতলা ঘাট পর্যন্ত রাস্তার দু’ধারে পুতুলের মেলা বসে। এই শহরেরই চেতলাঙ্গিয়া গোপাল মন্দিরে উৎসব পালিত হয় রাজস্থানী ঘরানায়। রাজস্থানের পাথরেই তৈরি এই মন্দিরশৈলীও রাজস্থানী ঘরানার।
মায়াপুরেও শুরু হয়েছে জন্মাষ্টমীর অর্চনা। শোভাযাত্রা থেকে পুষ্পবৃষ্টি, মায়াপুর আড়ম্বরে ছাপিয়ে যায় বাকি সকলকে। |