‘মাওবাদী ধাত্রীভূমি’ বেলপাহাড়িতে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে প্রথম পা রেখে ‘ভয় জয় করার’ নিদান দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বেলপাহাড়ির মানুষের প্রতি তাঁর আহ্বান, “আপনারা নিজেরাই নিজেদের পাহারাদার হোন। ভয় পাবেন না। শান্তি ও গণতন্ত্র রক্ষা করুন।”
একটা সময় পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলপাহাড়ি ছিল মাওবাদীদের ‘আঁতুড়ঘর’। আজও সেই চোরাস্রোত রয়েছে। মানুষকেই এই অবস্থা পাল্টাতে বলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, “তিনটের পরে বাস চলবে না, বাজার বন্ধ হবে এ সব হবে না। মাওবাদীরা আদর্শ নিয়ে লড়াই করলে কিছু বলার নেই। কিন্তু বন্দুক হাতে ভয় দেখালে সহ্য করব না।”
পরে ফেসবুকেও তিনি লেখেন, ‘ইতিহাসই বলে, বন্দুকের শাসনে কখনও শান্তি আনতে পারে না।’
বুধবার দুপুরে এক প্রশাসনিক কর্মসূচিতে বেলপাহাড়িতে আসেন মুখ্যমন্ত্রী। এর আগে শেষ এসেছিলেন ২০০৪-এ আমলাশোলে অনাহারে মৃত্যুর ঘটনার পরে। মমতা মনে করিয়ে দেন, ১৯৯৪ সালে জোড়াম গ্রামে গিয়ে দেখেছিলেন কী ভাবে কন্দ ও পিঁপড়ে সেদ্ধ খেয়ে দিন কাটান আদিবাসীরা। অধিগ্রহণে জট। অথচ জমি একান্ত জরুরি।
অতএব প্রস্তাব: তিন বছরের জন্য লিজে জমি নেওয়া হোক। জমি-মালিকেরা ওই তিন বছর ধরে বার্ষিক ক্ষতিপূরণ তো পাবেনই, উপরন্তু কাজ মিটলে ফেরত পাবেন পলিসমৃদ্ধ আরও উঁচু ও উর্বর জমি। হলদিয়া বন্দরমুখী ‘জলপথ’ জেলিংহাম চ্যানেলের পলি-সমস্যা সুরাহার লক্ষ্যে কলকাতা বন্দর-কর্তৃপক্ষ (কেপিটি) এমনই পরিকল্পনা করেছেন। তাঁদের বক্তব্য, ড্রেজিং করে তোলা পলি গভীর সমুদ্রে ফেললে তা আবার নদীতেই ফিরে আসে। সুতরাং চ্যানেলের জমা পলি তুলে যাতে গভীর সমুদ্রের পরিবর্তে পাশের জমিতে ফেলা যায়, সে জন্য জমি জোগাড় করতেই এই মর্মে তাঁরা প্রস্তাব দিয়েছেন রাজ্য সরকারকে। শালবনির ইস্পাত প্রকল্পে জমির চাহিদা মেটাতে জিন্দালরা জমি-মালিকদেরও প্রকল্পের অংশীদার করে ‘দৃষ্টান্ত’ স্থাপন করেছিল। ওখানে জমির কোনও সমস্যা হয়নি। জমি সংস্থানে অভিনবত্বের নিরিখে বন্দরের দেওয়া ‘সূত্র’টিও তার সঙ্গে পাল্লা টানতে পারে বলে প্রশাসনিক মহলের একাংশ মনে করছেন।
বন্দর-কর্তৃপক্ষের দাবি: হলদিয়া বন্দরকে বাঁচাতেই ওই জমির দরকার। কারণ সাগর থেকে যে জলপথ ধরে হলদিয়ায় জাহাজ ঢোকে, পলিমাটি জমে সেই জেলিংহাম চ্যানেলে ছোট-ছোট টিলা গজিয়ে উঠছে। ধাক্কা খাওয়ার ভয়ে বড় জাহাজ পণ্য নিয়ে বন্দরে ঢুকতে পারছে না, অন্য বন্দরে চলে যাচ্ছে। এতে হলদিয়ার ব্যবসা মার খাচ্ছে বিস্তর।
বন্দর-সূত্রের তথ্য: অধিকাংশ জাহাজ এখন তাদের অন্তত ৬৫% মাল (কার্গো) পারাদ্বীপ বা বিশাখাপত্তনমে খালাস করে সাকুল্যে গড়ে ৩৫% পণ্য নিয়ে হলদিয়ায় ঢুকছে। কোকিং কোল, আকরিক লোহা, খনিজ, পেট্রোপণ্যবাহী যে সমস্ত জাহাজ আগে হলদিয়ায় প্রায় ৬০% মাল নামাত, তাদের আসা কমছে।
তাই সমূহ দুর্গতিতে পড়েছে হলদিয়া। যার সুরাহা করতে হলে জেলিংহামের পলিস্তূপকে ড্রেজার দিয়ে পাকাপাকি ভাবে চেঁছে ফেলা ছাড়া উপায় নেই বলে বন্দর-কর্তারা মনে করছেন। আর তা করতে হলে পলি তুলে ডাঙায় ফেলতে হবে, সমুদ্রে নয়। এই কারণেই ১৮৯৪-এর কেন্দ্রীয় জমি অধিগ্রহণ আইনের ৩৫ নম্বর ধারা অনুযায়ী নন্দীগ্রামের সাউখালি চর ও নাকচিরা চরে প্রায় ৪৯৫ একর তিন বছরের জন্য ‘ভাড়া’ নিতে চাইছেন বন্দর-কর্তৃপক্ষ।
বন্দর অভিমুখী জলপথের নাব্যতা বজায় রাখতে নিয়মিত ড্রেজিং হলেও কর্তৃপক্ষের তাতে ভরসা নেই। তারা বলছেন, ড্রেজিং কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া (ডিসিআই) জেলিংহামের বুক থেকে যে পলি তোলে, তা ফেলা হয় বন্দরের অনেকটা দূরে, সাগরের গভীর গর্তে। ওই পলি জোয়ারের জলে মিশে ফের চ্যানেলে চলে আসে। এ ভাবে কাজের কাজ তো হচ্ছেই না, উল্টে ড্রেজিং-খরচ বাবদ ফি বছর চারশো কোটি টাকা কার্যত জলেই যাচ্ছে বলে বন্দর-কর্তাদের দাবি।
কাজেই পলিকে ‘পাকাপাকি ভাবে’ দূরে রাখতে হলে তা ডাঙায় জমা করাই একমাত্র পথ। কলকাতা বন্দরের চেয়ারম্যান মণীশ জৈন জানিয়েছেন, এই উদ্দেশ্যে আগে রাজ্যকে জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন বন্দর-কর্তৃপক্ষ।
বন্দর-সূত্রের খবর: নন্দীগ্রামের কেন্দেমারি থেকে তালপট্টি পর্যন্ত প্রায় দশ কিলোমিটার বরাবর পাঁচশো মিটার চওড়া জায়গা জুড়ে যাতে জেলিংহামের মাটি ফেলা যায়, সে জন্য ২০০৫-’০৬ সালে তদানীন্তন বামফ্রন্ট সরকারকে দেড় হাজার একর অধিগ্রহণের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু এর পরে-পরেই নন্দীগ্রামে অন্য এক প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের সরকারি বিজ্ঞপ্তির প্রতিবাদে তীব্র আন্দোলন দানা বাঁধে, পুলিশের গুলিতে মারা যান বেশ কিছু লোক। দেশ জুড়ে ঝড় ওঠে। জমি অধিগ্রহণ নিয়ে জাতীয়স্তরের বিতর্কের পিছনে সেই ‘নন্দীগ্রাম-পর্বের’ ভূমিকা সুবিদিত, যার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গিয়েছে রাজ্যের তদানীন্তন বিরোধী নেত্রী, অধুনা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামও।
স্বভাবতই নন্দীগ্রাম-পর্বের পরিপ্রেক্ষিতে বন্দর-কর্তৃপক্ষের অধিগ্রহণ-প্রস্তাবটি তখন ঠান্ডা ঘরে চলে গিয়েছিল। এখনও তা ফাইলবন্দি। এই পরিস্থিতিতে নতুন প্রস্তাব পাঠিয়ে লিজে জমি চাওয়া হয়েছে। এ ভাবে জমি দিলে স্থানীয় মানুষের কী লাভ হবে?
সম্প্রতি রাজ্য সরকার এ কথা জানতে চেয়েছিল বন্দর-কর্তৃপক্ষের কাছে। জবাবে গত ৩ জুলাই রাজ্যের ভূমি দফতরকে বন্দরের তরফে দেওয়া এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, তিন বছরের জন্য জমি ‘জমা’ রাখলে মালিকেরা সরকার-নির্ধারিত দরে বছরওয়াড়ি ক্ষতিপূরণ পাবেন। উপরন্তু ওই সময়ে পলিমাটি জমে জমে সাউখালি চর ও নাকচিরা চরের উর্বরতা বাড়বে, তা নদীতলের চেয়েও উঁচু হয়ে ওঠায় চাষের পক্ষে আরও নিরাপদ হয়ে উঠবে। অর্থাৎ তিন বছর বাদে চাষিরা যে জমি ফেরত পাবেন, তার কৃষিযোগ্যতা হবে অনেক বেশি। বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞেরাও সমীক্ষা করে একই মত প্রকাশ করেছেন বলে বন্দর-কর্তৃপক্ষের দাবি।
জেলিংহাম চ্যানেলের উত্তরে সাউখালি চরের প্রায় ছ’বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ১৭০টি পরিবারের বাস। নাকচিরার ১৪ বর্গ কিলোমিটারে থাকে ২১০টি পরিবার। চাষবাস ও মাছ ধরাই মূল জীবিকা। তাঁদের কী মত?
নাকচিরার কালীচরণপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্য সোয়েম কাজির বক্তব্য, “আমাদের এমপি শুভেন্দু অধিকারী ক’দিন আগে জানিয়েছিলেন, পলি ফেলার জন্য অল্প সময়ের লিজে জমি নেওয়া হবে। এ ব্যাপারে উনি আমাদের জমি-মালিকদের সঙ্গে কথা বলতে বলেছেন। আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হবে।” নাকচিরার চাষি পরেশ জানা বলেন, “এখনও তেমন কিছু শুনিনি। সকলে একমত হলে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবা যেতেই পারে।” সাউখালির বনবিহারী মণ্ডলের মন্তব্য, “পঞ্চায়েতের লোকজনকে নিয়ে আলোচনা হোক। সকলে রাজি হলে জমি দেওয়া যাবে। তবে শর্ত আগে জানতে হবে।”
প্রশাসন কী বলছে?
মহাকরণ-সূত্রের খবর: রাজ্যের ভূমি-কর্তাদের কাছেও প্রস্তাবটি প্রাথমিক ভাবে গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। এ ব্যাপারে পূর্ব মেদিনীপুরের জেলাশাসককে যত শীঘ্র সম্ভব স্থানীয় পঞ্চায়েত ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে একটি রিপোর্ট পাঠাতে বলেছে ভূমি দফতর। বন্দর-চেয়ারম্যানের কথায়, “সরকারের সঙ্গে আলোচনা চলছে। যত তাড়াতাড়ি জমি মেলে, হলদিয়া বন্দরের ততই মঙ্গল।”
শালবনির পরে জেলিংহামও রাজ্যে জমি-সমস্যা মোকাবিলার ‘দৃষ্টান্ত’ গড়তে পারে কি না, সেটাই এখন দেখার। |