|
|
|
|
‘ভয় জয় করুন’, আহ্বান মুখ্যমন্ত্রীর |
কিংশুক গুপ্ত • বেলপাহাড়ি |
‘মাওবাদী ধাত্রীভূমি’ বেলপাহাড়িতে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে প্রথম পা রেখে ‘ভয় জয় করার’ নিদান দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বেলপাহাড়ির মানুষের প্রতি তাঁর আহ্বান, “আপনারা নিজেরাই নিজেদের পাহারাদার হোন। ভয় পাবেন না। শান্তি ও গণতন্ত্র রক্ষা করুন।”
একটা সময় পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলপাহাড়ি ছিল মাওবাদীদের ‘আঁতুড়ঘর’। আজও সেই চোরাস্রোত রয়েছে। মানুষকেই এই অবস্থা পাল্টাতে বলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, “তিনটের পরে বাস চলবে না, বাজার বন্ধ হবে এ সব হবে না। মাওবাদীরা আদর্শ নিয়ে লড়াই করলে কিছু বলার নেই। কিন্তু বন্দুক হাতে ভয় দেখালে সহ্য করব না।” পরে ফেসবুকেও তিনি লেখেন, ‘ইতিহাসই বলে, বন্দুকের শাসনে কখনও শান্তি আনতে পারে না।’
বুধবার দুপুরে এক প্রশাসনিক কর্মসূচিতে বেলপাহাড়িতে আসেন মুখ্যমন্ত্রী। এর আগে শেষ এসেছিলেন ২০০৪-এ আমলাশোলে অনাহারে মৃত্যুর ঘটনার পরে। মমতা মনে করিয়ে দেন, ১৯৯৪ সালে জোড়াম গ্রামে গিয়ে দেখেছিলেন কী ভাবে কন্দ ও পিঁপড়ে সেদ্ধ খেয়ে দিন কাটান আদিবাসীরা। |
|
অবনত। বেলপাহাড়ির জনসভায় আত্মসমর্পণ মাওবাদীর। বুধবার। ছবি: অশোক মজুমদার। |
বেলপাহাড়িতে এর আগে রাজ্যের দুই মুখ্যমন্ত্রী এসেছিলেন। ১৯৭২ সালে ‘খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রে’র উদ্বোধন করতে এসেছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। ১৯৯৬ সালে শিলদায় নির্বাচনী সভা করেন জ্যোতি বসু। মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বেলপাহাড়িতে আসেননি। এই প্রসঙ্গে মমতার বক্তব্য, “বাম আমলে সরকারের কেউ জঙ্গলমহলে ঘেঁষত না। কিন্তু এখন গোটা সরকার জঙ্গলমহলে আসছে। আবারও আসব।” এই দিন মঞ্চে ছিলেন রেলমন্ত্রী মুকুল রায়, মুখ্যসচিব সমর ঘোষ, রাজ্য পুলিশের ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায়, পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলাশাসক সুরেন্দ্র গুপ্ত, ঝাড়গ্রামের পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষও। মমতা বুঝিয়ে দেন, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি চান, সরকারকে নিজের ভেবে মাওবাদীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হোক জঙ্গলমহলের গরিব মানুষ। তিনি বলেন, “আপনাদের কোনও সমস্যা থাকলে ব্লক অফিসে আসুন। সরকার আপনাদের পাশে রয়েছে। তবে অপরিচিত কাউকে বাড়িতে ঠাঁই দেবেন না। ভবিষ্যতে বিপদ ডেকে আনবেন না।”
ফেসবুকে তিনি বেলপাহাড়ির ‘পরিবর্তনের’ কথাও উল্লেখ করেন। লেখেন, ‘দীর্ঘদিন বেলপাহাড়ি এবং তার সংলগ্ন এলাকায় বন্দুকের শাসন চলেছে। কিন্তু এখন পরিবর্তন এসেছে। শান্তি ও উন্নয়ন জাদু দেখিয়েছে। তাই এক লাখেরও বেশি মানুষ এ দিন শান্তিপূর্ণ ভাবে বেলপাহাড়ির সভায় যোগ দেন।’ |
|
জঙ্গলমহলে জননেত্রী: আদিবাসী মহিলার হাতে জমির
পাট্টা তুলে দিচ্ছেন মমতা। বেলপাহাড়িতে। ছবি: দেবরাজ ঘোষ |
মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর এই নিয়ে পঞ্চমবার জঙ্গলমহল সফরে এলেন মমতা। মঙ্গলবার রাতেই ঝাড়গ্রামে পৌঁছন তিনি। রাজবাড়িতে রাত কাটান। মাওবাদী আতঙ্কে যে ঝাড়গ্রাম এক সময় সূর্যাস্তের পরই নিঝুম হয়ে যেত, রাতেই সেখানে পৌঁছে যেন ‘অবস্থা পরিবর্তনের’ বার্তা দিয়েছেন মমতা। এ দিন সকাল ১১টায় ঝাড়গ্রাম এসপি অফিসে পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। উন্নয়ন পরিকল্পনার দ্রুত বাস্তবায়নে জোর দেন। নির্দেশ দেন, “পুলিশ-প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয় রক্ষা করে উন্নয়নের কাজ করতে হবে। কাউকেই ভয় পেলে চলবে না।” |
|
মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর পঞ্চম বার জঙ্গলমহল সফরে এলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
তবে মুখ্যমন্ত্রী
হিসেবে
বেলপাহাড়িতে এই প্রথম। বেলপাহাড়ির সভার একটি মুহূর্ত। দেবরাজ ঘোষের তোলা ছবি। |
বিডিও অফিস সংলগ্ন বেলপাহাড়ি ব্লক ময়দানের অনুষ্ঠানে এই দিন একগুচ্ছ প্রকল্পের শিলান্যাস করেন মমতা। বিলি করা হয় কিষান ক্রেডিট কার্ড, ‘নিজ গৃহ নিজ ভূমি’ প্রকল্পের পাট্টা। অলচিকি সহ-শিক্ষকদের হাতে নিয়োগপত্র তুলে দেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রতি ব্লকে আইটিআই থেকে কেন্দুপাতার দাম বাড়ানো জঙ্গলমহলের সার্বিক উন্নয়নে ঢালাও প্রতিশ্রুতি দেন মমতা। গত মে মাসে আত্মসমর্পণকারী সাত ‘মাওবাদী’র হাতে ‘আর্থিক পুনর্বাসন প্যাকেজ’ তুলে দেন মুখ্যমন্ত্রী। ঝাড়গ্রামের মাসাংডিহি গ্রামের বাসিন্দা ‘মাওবাদী স্কোয়াড সদস্য’ রবি মুর্মু ও তাঁর স্ত্রী অম্বিকা অস্ত্র জমা দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। |
|
ঝাড়গ্রাম এসপি অফিসে রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি মাল্যদান। বুধবার দেবরাজ ঘোষের তোলা ছবি। |
অতীত বলছে, জঙ্গলমহলের বেকার যুব-সম্প্রদায়কে প্রভাবিত করেই এলাকা বাড়িয়েছিল মাওবাদীরা। এই প্রবণতায় দাঁড়ি টানতে কর্মসংস্থানের ঢালাও প্রতিশ্রুতি দেন মুখ্যমন্ত্রী। পুলিশে ইতিমধ্যে ১০ হাজার নিয়োগ হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “পুলিশে আরও ৫ হাজার, রেলপুলিশে আরও ৭০০ জনকে নিয়োগ করা হবে। স্কুল, অঙ্গনওয়াড়িতেও লোক নেওয়া হবে।” কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তৈরির কথা বলেন মমতা। জোর দেন পর্যটনে। পাহাড়ের ঢঙে জঙ্গলমহলেও ‘হোম স্টে’ পদ্ধতি প্রয়োগের কথা বলেন তিনি। যেখানে স্থানীয় বাসিন্দাদের বাড়িতেই থাকা-খাওয়া করবেন ‘অতিথি’ পর্যটকরা।
পাশাপাশি, আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনে বেলপাহাড়ি সহ গোটা জঙ্গলমহলে ‘পরিবর্তন’-এর ডাক দিয়েছেন তিনি। ভিড়ে ঠাসা সভার একেবারে শেষলগ্নে মানুষকেই মমতা জিজ্ঞেস করেছেন, “পঞ্চায়েতে পরিবর্তন হবে তো?”
জবাব এসেছে, হ্যাঁ। |
প্রতিশ্রুতির সাতকাহন |
• জঙ্গলমহলের ৮০টি মাধ্যমিক স্কুলকে
উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে উন্নীত করা হবে।
• পুলিশে নিয়োগ আরও পাঁচ হাজার। রেলপুলিশে সাতশো।
• গ্রামাঞ্চলে গ্রাম্য-পুলিশ ও কিষাণবন্ধু।
• জঙ্গলমহলে পর্যটন-শিল্পের উন্নয়ন, ‘হোম ট্যুরিজমে’ বিশেষ গুরুত্ব।
• সব ব্লকে কিষাণ বাজার ও হিমঘর
• জঙ্গলমহলে আরও ১,৭৩৬ জন শিক্ষক।
• ঝাড়গ্রাম আদালতে স্থায়ী দু’জন অতিরিক্ত জেলা-দায়রা বিচারক।
|
জঙ্গলমহলের প্রাপ্তি |
জঙ্গলমহলের ৫টি নলবাহিত জল সরবরাহ প্রকল্পের উদ্বোধন।
লালগড়ে সহায়ক সেবিকা ও ধাত্রী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, শালবনিতে আইটিআই, গড়বেতার
নয়াবসতে
পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মু আবাসিক বিদ্যালয়, মেদিনীপুর সদরে জেলা যুব কেন্দ্র,
বেলপাহাড়ির
শুকজোড়ায় নলবাহী প্রকল্প এবং ঝাড়গ্রামে
জনজাতি কলা সংগ্রহশালার শিলান্যাস।
|
আত্মমর্পণকারী ৭ জন মাওবাদীকে ‘পুনর্বাসন প্যাকেজ’ প্রদান। |
মাওবাদী হানায় নিহত ৪ জনের পরিজনকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদান। কিষান ক্রেডিট কার্ড বিলি,
‘নিজ গৃহ নিজ ভূমি’র পাট্টা বিলি, ভূমিহীনদের জমির পাট্টা, বনবাসী পাট্টা বিলি, ক্রীড়া সরঞ্জাম ও
ক্ষুদ্র সেচের যন্ত্রপাতি বিলি, প্রতিবন্ধী পড়ুয়াদের হুইলচেয়ার ও শ্রবণযন্ত্র, লোধাদের হাতে বাড়ির চাবি,
অলচিকি প্যারা টিচারদের নিয়োগপত্র প্রদান, কয়েকটি স্কুলকে জনজাতির চিরায়ত বাদ্যযন্ত্রাদি প্রদান। |
|
|
|
|
|
|