এ বার দেশের যাযাবরদেরও জনগণনা-র আওতায় আনা হবে।
ব্রিটিশ আমলে এ দেশের একাধিক আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে ‘অপরাধী’ তকমা নিয়ে নিষিদ্ধ তালিকার অন্তর্ভুক্ত করে রাখা হয়েছিল। এবং তাদের জনগণনার আওতা থেকে বাদ রাখা হয়েছিল। স্বাধীনতার পরে এই সব জনগোষ্ঠীর গা থেকে ‘অপরাধী’ তকমা তুলে দেওয়া হলেও এদের মূলস্রোতে আনার জন্য সে ভাবে কোনও চেষ্টা হয়নি। কিন্তু সম্প্রতি সনিয়া গাঁধী নেতৃত্বে ন্যাশনাল অ্যাডভাইসরি কাউন্সিল বা ন্যাক কেন্দ্রীয় সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে, হিসেবের বাইরে থাকা এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে দেশের মূলস্রোতে সামিল করার উদ্যোগ নিতে হবে। ওই সব জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগই যাযাবরের জীবনযাপন করে। ন্যাক-এর বক্তব্য, যে ভাবে এদের ‘অপরাধী’ তকমা দিয়ে জনগণনা থেকে বাদ দেওয়া হয়ে আসছে, তা মোটেই যুক্তিসঙ্গত নয়। তাই, দেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে ওই সব গোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করতে উদ্যোগী হয়েছে কেন্দ্র।
দেশের রেজিস্ট্রার জেনারেল অ্যান্ড কমিশনার অফ সেন্সাস সি চন্দ্রমৌলির অবশ্য দাবি, জনগণনায় সব আদিবাসীকেই যুক্ত করা হয়। তাঁর কথায়, “সমস্ত আদিবাসী গোষ্ঠীর মানুষদের গণনা করা হয়। এমনকী যাযাবরদেরও গণনা করা হয়। তবে গোষ্ঠীর নাম অনুযায়ী কোনও গণনা করা হয় না। আমরা শুধু আদিবাসী কি না, এটাই জানতে চাই। এ বিষয়ে এর বেশি কিছু আমার জানা নেই।”
উপেক্ষিত এই যাযাবরেরা বেশির ভাগ সময়েই দল বেঁধে থাকে। মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেড়ায় ওষধি শিকর-বাকর, লতাপাতার খোঁজে। গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে খেলা দেখায়। চোখ বেঁধে তির ছোঁড়া, দড়ির উপর দিয়ে হাঁটা বা মাদারির খেলা দেখিয়ে পয়সা পায়। কখনও বিক্রি করে সাপের বিষ নামানোর ‘অব্যর্থ’ পাথর বা যৌবন পুনরুদ্ধারের জড়িবুটি! এখানে-ওখানে তাঁবু খাটিয়ে কয়েক দিন করে থাকে, ফের উধাও হয়ে যায়। কখনও কখনও এলাকায় কোনও অপরাধের ঘটনা ঘটলেই পুলিশের নজর পড়ে ওদের দিকে। ফলে রাতারাতি তাঁবু গুটিয়ে অন্যত্র পাড়ি দিতে হয় ওদের। সমাজের মূলস্রোতের বাইরে ওরা। যাযাবর জীবনের বাইরে আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়া ওরা আজও পায়নি।
ব্রিটিশরা এ দেশের দু’শোটি আদিবাসী গোষ্ঠীকে তথাকথিত ‘অপরাধী’ গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করে দেশের মূলস্রোতে থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। আদিবাসী সংস্কৃতি সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞদের ধারণা, মূলত তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার ‘অপরাধে’ই ব্রিটিশ সরকার ওই আদিবাসীদের বংশানুক্রমে ‘অপরাধী’ বলে চিহ্নিত করেছিল। এদের বেশির ভাগই যাযাবর। কোথাওই ওরা বসতি স্থাপন করতে পারত না। যেখানেই কোনও বসতি গড়ে তোলার চেষ্টা করত, সেখান থেকেই ওদের উচ্ছেদ করে দিত ব্রিটিশ পুলিশ। এদের দমিয়ে রাখার জন্য ‘ক্রিমিন্যল ট্রাইবস্ অ্যাক্ট (সিটিএ), ১৮৭১’ নামে একটি দমনমূলক আইন প্রণয়ন করে ব্রিটিশরা। ১৯১১ এবং ১৯২৪ সালে এই আইনের সংশোধনও করা হয়।
স্বাধীনতার পর ‘ক্রিমিনাল ট্রাইবস্ অ্যাক্ট’ প্রসঙ্গে জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন, “এই আইনটি স্বাধীন ভারতের আইনের বইতে একটি কালো দাগ!” ১৯৫২ সালে ‘ক্রিমিনাল ট্রাইবস্ অ্যাক্ট’ বাতিল করে প্রায় ১২৭টি জনগোষ্ঠীর এক কোটি ৩০ লক্ষ মানুষের উপর থেকে ‘অপরাধী’ ছাপ মুছে ফেলা হয়। কিন্তু তার পরেও এদের সমাজের মূলস্রোতে ফেরানোর জন্য সরকারি ভাবে কোনও চেষ্টা চালানো হয়নি। তাদের ‘ডিনোটিফায়েড, নোমাডিক অ্যান্ড সেমি-নোম্যাডিক ট্রাইবস্’ বা ‘ডিএনটি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ‘অপরাধী’ তকমা সরকারি ভাবে তুলে দেওয়া হলেও এদের সম্পর্কে সমাজের মূলস্রোতের ভাবনা বিশেষ বদল হয়নি। আজও এরা শিক্ষিত সমাজের কুসংস্কার এবং বৈষম্যের শিকার।
ব্রিটিশ আইন রদ হলেও ওই দু’শোটি গোষ্ঠীর মানুষ এখনও দেশের জনগণনা প্রক্রিয়ার বাইরেই রয়ে গিয়েছেন। ফলে এঁদের সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। তবে সংখ্যাটা যে বেশ কয়েক কোটি, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই জাতীয় উপদেষ্টা পরিষদের। ন্যাকের। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী
সংস্থার হিসেব অনুযায়ী, এই যাযাবর-আধা যাযাবর
এবং ডিনোটিফায়েড আদিবাসীর সংখ্যা প্রায় ৬ কোটি। ন্যাক-এর বক্তব্য, মূলস্রোতের হিসেবে না থাকায় ওই আদিবাসীরা বিভিন্ন মৌলিক পরিষেবা থেকেও বঞ্চিত।
এ দেশের ভূমিপুত্র হলেও নাগরিক হিসেবে এদের
কোনও পরিচয় কোথাও নেই। ভোটাধিকারও নেই। তা ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের ‘গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশন’, ‘শিক্ষার অধিকার’ এবং ‘রোজগার গ্যারান্টি যোজনা’-র মতো বহু প্রকল্প থেকেই এরা আজও বঞ্চিত। বঞ্চিত আধুনিক স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকেও। ন্যাক-এর মতে, আদম সুমারিতে দেশের লোকসংখ্যার পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক যে চিত্র উঠে আসে সেখানে এই ‘অদৃশ্য ভারতীয়’দের যুক্ত করাটা খুবই জরুরি। |