সোনতলির চর-চাপোরি তলিয়ে যাচ্ছে আগ্রাসী ব্রহ্মপুত্রের গর্ভে
সোনতলির চর, ১১১ বছরের ঐতিহ্য আঁকড়ে কোনও মতে চলছে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। মহাবাহু ব্রহ্মপুত্র যে ভাবে হাত বাড়াচ্ছে, তাতে সোনতলি চর আর কতদিন থাকবে বলা মুশকিল। গ্রামবাসীদের হিসেবে, গত দু’বছরের মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়েছে ১২টি গ্রাম। ভাঙা পাড় আর ব্রহ্মপুত্রের গর্ভে তলিয়ে যেতে থাকা জমি-বাড়ির খতিয়ানের হিসেব করাই আপাতত সোনতলির রোজনামচা।
কামরূপ জেলার বকো অন্তর্গত সোনতলি-গরৈমারি-মাহতলি-পানিখাইতির চর কেবল কৃষিতেই নয়, সংস্কৃতিতেও নবল ভূখণ্ডের সঙ্গে সমানে পাল্লা দেয়। কামরূপ জেলা যেখানে ব্রহ্মপুত্রে মেশে, সেইখানে ব্রহ্মপুত্রের বুকে জেগে উঠেছিল সোনতলি চর। তবে গত একশো বছরে নদী গতিপথ পরিবর্তন করায় চর এখন মূল ভূখণ্ডের যুক্ত হয়ে ‘চর’ থেকে ‘চাপোরি’ (নদী পাড়ের অঞ্চল) হয়ে গিয়েছে।
সর্বনাশের আশঙ্কায়। পায়ের তলার মাটি কত দিন আছে, জানেন না সোনতলির মানুষ। উজ্জ্বল দেবের তোলা ছবি।
ব্রহ্মপুত্র পাড়ি দিয়ে উত্তর-পূর্বে ঢোকার সময় ইংরেজ বণিকের প্রথম জাহাজ এই সোনতলিতেই বাঁধা হয়েছিল। সোনাতলির বর্তমান বাজার থেকে সেই ‘খোলাবান্ধা’ নদী-বন্দরের দূরত্ব প্রায় ৩ কিলোমিটার। তবে উত্তর-পূর্বের প্রথম নদী-বন্দর এখন ব্রহ্মপুত্রের গর্ভে। মুছে গিয়েছে আরও অনেক কিছু। তবে সংস্কৃতির ঐতিহ্য আর সম্প্রীতির শক্ত গিঁট এখনও আলগা হতে দেননি আজাদ উসমান গনি, রবিউল হুসেন, ইসমাইল হুসেনরা। তাই অসমের চর এলাকাগুলির মধ্যে সবচেয়ে বড় করে বিহু পালন হয় এখানেই। চর-চাপোরি মিলিয়ে মুসলিমরা জনসংখ্যার প্রায় ৯৫ শতাংশ। তাঁদের হাত ধরেই এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে রমরমিয়ে চলছে বিহু, শঙ্করগীত, দেবধ্বনী। শিক্ষক, ব্যবসায়ীদের উদ্যোগে গত ২৪ বছর ধরে ঘোড়দৌড়ও বহাগী বিহুর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। রৌমারির মকসেদ আলি আহমেদের লাঠিবাড়ি দলের খেলা ছাড়া বিয়ে-শাদি, মহরম বা বিহু সম্পূর্ণ হয় না চর-চাপোরিতে। দুই হাতে চারটি লাঠি নিয়ে লাঠালাঠি আর হেরে গিয়ে ‘বগা’ দেখানোর মজাটা এখন অসমের এক লুপ্তপ্রায় ঐতিহ্য। কার্যত এক সঙ্গে লাঠিবাড়ি, দেবধ্বনী আর বিহুর নাচ সোনতলি ছাড়া আর কোথায় মিলবে?
কিন্তু ভূমিক্ষয়ে চরের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। আর সরকারিভাবে বন্যার জন্য একাধিক প্রকল্প ও ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা থাকলেও ভূমিক্ষয়ের জন্য সে ভাবে কোনও কেন্দ্রীয় প্রকল্প নেই। রাজ্যের তরফেও প্রশাসনিক অবহেলার শিকার সোনতলি।
গুয়াহাটি থেকে তিন ঘণ্টার পথ পেরিয়ে সোনতলি পরিদর্শন বাংলো। তারপর আর গাড়ি যাবে না। সোনতলিতে আক্ষরিক অর্থেই ‘গাড়িঘোড়া’ চলে। প্রাচীন বন্দর এলাকা হওয়ায় মাল আনা নেওয়ায় খচ্চরের গাড়ি এখানে অপরিহার্য্য ছিল। সেই চলটাই রয়ে গিয়েছে। ঘোড়া নয়, বাইকে চেপে প্রায় অগম্য রাস্তা কোনও ক্রমে পার হয়ে ব্রহ্মপুত্র অবধি পৌঁছনো গেল। এর পর নৌকায় একের পর এক চরে ঘুরে ভাঙনের চেহারা দেখালেন আজাদ গনি, ইসমাইল সাহেবরা। পানিখাইতি আসা-যাওয়ার পথে, ভাঙন একের পর এক গ্রাম গ্রাস করে নিয়েছে।
ওঁদের দাবি, গত কয়েক দশকে এখানকার ৬০টি গ্রাম পুরো হারিয়ে গিয়েছে। নদী ৬ কিলোমিটার এগিয়ে এসেছে সোনতলির দিকে। গত দু’বছরের মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়েছে আরও ১২টি গ্রাম। ডুবেছে বহু স্কুল। দলে দলে ঘরহারা মানুষ অন্যান্য চরে নিরাশ্রয় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। ইসমাইল সাহেবের কথায়, “সাহায্য চাইতে গেলে প্রশাসন ‘বাংলাদেশি’ নাম দিয়ে অবজ্ঞা করে। ভোট চাওয়ার সময় রাজনৈতিক দলগুলি মুসলিম বলে মাথায় তোলে। আমাদের এখানকার হাজার হাজার নিরাশ্রয় মানুষ, সংস্কৃতি, পঠন-পাঠন গোল্লায় দিয়ে কেবল ভাঙনের আতঙ্কে জলের ধারে বসে থাকছেন। তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই!” ভাঙন নিশ্চিত জেনেও নদীর আধ কিলোমিটারের মধ্যে কোটি টাকা খরচ করে বানানো হচ্ছে নতুন স্বাস্থ্যকেন্দ্র। নেউলডোবা থেকে সোনতলি আসার জন্য সেতু বানানো হচ্ছিল। ২০০০ সালে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই সেতু ভেঙে পড়ে। আর মির্মাণ হয়, পড়ে রয়েছে ভাঙা এক ধ্বংসস্তুপ।
পানিখাইতির চরে, চোখের সামনে ভেঙে পড়তে থাকে ৫/৭ ফুট মাটির পার। কিন্তু জেলাশাসক এস কে রায় ফোনে বলছেন, ভূমিক্ষয়ে গ্রাম তলিয়ে যাওয়ার মতো কোনও ঘটনাই সোনতলিতে ঘটেনি! তিনি বলেন, “যদি সোনতলিতে এমন ঘটনা ঘটত সার্কল অফিসার নিশ্চয়ই বলতেন। ভূমিক্ষয় হচ্ছে তা সত্য। তা নিয়ে জলসম্পদ বিভাগ কাজ শুরু করেছে। কিন্তু গ্রামের ক্ষতি হয়নি। তাহলে সাহায্য দেওয়ার প্রশ্ন উঠছে কীভাবে?” গণি, ইসমাইল, রবিউলবাবুরা বলেন, “আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে একবার এখানে ঘুরে গেলেই কর্তারা জানতে পারতেন কী হচ্ছে। কিন্তু তাঁদের সময় কোথায়?” সরকারি রিপোর্টে নাম তোলার অপেক্ষায় থেকে ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে সোনতলির চর। ডুবছে তার সংস্কৃতিও।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.