কেন্দ্রে অ-বিজেপি প্রধানমন্ত্রীর সম্ভাবনার কথা বলে এ বারে দল ও শরিকদের প্রকাশ্য অসন্তোষের মুখে পড়লেন লালকৃষ্ণ আডবাণী। পরিস্থিতি সামাল দিতে বিজেপি এক দিকে যেমন ঐক্যের চেহারাটি দেখানোর চেষ্টা করছে, তেমনই অরুণ জেটলির একটি প্রবন্ধের কপি বিলি করে বোঝানোর চেষ্টা করছে, আডবাণীর মন্তব্য দলের অবস্থান নয়।
দু’দিন আগে আডবাণী তাঁর ব্লগে লিখেছেন, পরের লোকসভা নির্বাচনে অ-কংগ্রেসি, অ-বিজেপি প্রধানমন্ত্রী হওয়া সম্ভব। তাঁর এই মন্তব্যের জেরে নিতিন গডকড়ী, রাজনাথ সিংহরা যেমন চটেছেন, তেমনই ক্ষুব্ধ সঙ্ঘ ও শরিক দলের নেতারাও। প্রধানমন্ত্রী পদের প্রার্থী হওয়ার প্রশ্নে নীতীশ কুমারদের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়ে আডবাণী আসলে নরেন্দ্র মোদীকে ঠেকাতে চাইছেন বলেও অভিযোগ উঠছে দলের অন্দরে।
গত কাল পর্যন্ত বিজেপি-র কেউ প্রকাশ্যে মুখ না খুললেও আজ কর্নাটকের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বি এস ইয়েদুরাপ্পা আডবাণীকে চিঠি লিখে জানিয়েছেন, এ ধরনের মন্তব্য দলের মনোবল ক্ষুণ্ণ করবে। শিবসেনা এর চেয়ে অনেক বেশি আক্রমণাত্মক। বাল ঠাকরে দলের মুখপত্র ‘সামনা’-তে লিখেছেন, “যুদ্ধের আগে খোদ সেনাপতিই গোটা বাহিনীর মনোবল ভেঙে দিলেন।” তবে একই সঙ্গে তিনি এ-ও মন্তব্য করেছেন যে, “আডবাণীর নেতিবাচক মন্তব্যে এনডিএ-র মনোবল ভাঙার কোনও কারণ নেই। আডবাণীর মনোবল ভেঙে গেলে বরং আমার বাড়িতে আসতে পারেন। আমি তাঁকে চাঙ্গা করে দিতে পারি।”
সঙ্ঘ এবং বিজেপি-র একটি বড় অংশ মনে করছে, দলে নেতৃত্ব নিয়ে কোন্দল উস্কে দিতেই আডবাণী নিজের ব্লগকে ব্যবহার করেছেন। নীতীশ কুমার যখন নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথে কাঁটা হয়ে উঠছেন, সেই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে নীতীশের মতো নেতাদের বাড়তি গুরুত্ব দিতে চাইছেন আডবাণী। দলের শীর্ষ নেতা হিসাবে মুখে তিনি বিজেপি-কে সঠিক পথে পরিচালনা এবং এনডিএ-কে আরও ঐক্যবদ্ধ করার কথা বললেও বাস্তবে আডবাণীর মন্তব্যে দলে নেতৃত্বের কোন্দল বাড়ল বই কমল না। তার থেকেও বড় বিষয়, সংগঠনকে মজবুত করে কংগ্রেস-বিরোধী আন্দোলনকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে আডবাণী দলের দুর্বলতার প্রসঙ্গই সামনে তুলে এনেছেন বলেও মনে করছেন বিজেপি নেতৃত্বের একাংশ।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে ঘরে-বাইরে তিনি সমালোচনার মুখে পড়লেও জেডি-ইউয়ের নীতীশ-অনুগামী নেতা আজ প্রকাশ্যেই আডবাণীর হয়ে সওয়াল করেছেন। দলের নেতা শিবানন্দ তিওয়ারি বলেন, “লালকৃষ্ণ আডবাণী দেশের সব থেকে অভিজ্ঞ নেতা। তাঁর বাস্তববোধ রয়েছে।” এরই সঙ্গে শিবানন্দ তাঁর দলের নেতা তথা বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর একপ্রস্ত প্রশস্তি করে বলেছেন, “নীতীশ কুমার প্রধানমন্ত্রী পদের প্রার্থী হওয়ার যোগ্য।” শিবানন্দ আডবাণীর হয়ে সওয়াল করলেও এনডিএ-র আহ্বায়ক এবং জেডি-ইউ নেতা শরদ যাদব গত কাল আডবাণীর মন্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন।
আডবাণী শিবিরের অবশ্য যুক্তি, তিনি অ-কংগ্রেসি ও অ-বিজেপি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনার কথা বললেও এ কথা জানাতেও ভোলেননি, অতীতে কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে চরণ সিংহ, চন্দ্রশেখর, দেবগৌড়া, ইন্দ্রকুমার গুজরাল কিংবা বিজেপি-র সমর্থন নিয়ে বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহ প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও সেই সব সরকার বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ফলে আডবাণীর মন্তব্য নিয়ে যে সমালোচনার ঝড় উঠেছে, সেটি একেবারেই অমূলক।
দু’ সপ্তাহ আগে এই বিষয়েই প্রবন্ধ লিখেছিলেন জেটলি। সেখানে তিনি বলেছেন, রাজ্যে-রাজ্যে শক্তি বাড়ছে আঞ্চলিক দলগুলির, কমছে কংগ্রেস। এই পরিস্থিতিতে পরের লোকসভায় জাতীয় দলগুলি কি সহযোগীর ভূমিকা নেবে, নাকি নেতৃত্ব দেবে সরকারে? জেটলিরও বক্তব্য, “জাতীয় দলের সমর্থনে আঞ্চলিক দলের নেতার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার চেষ্টা বিফল হয়েছে। কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্ক কমায় লোকসভাতে একমাত্র বিকল্প হতে পারে এনডিএ-ই। পরের লোকসভায় বিজেপির নেতৃত্বেই এনডিএ-র সরকার হবে। এবং এটাই দলের অবস্থান।” আডবাণীর কৌশলী ব্লগে তৈরি হওয়া পরিস্থিতি সামাল দিতেই পুরনো এই প্রবন্ধকে ঘটা করে বিলি করে দলের অবস্থান ব্যাখ্যা করল বিজেপি।
সংসদ শুরুর আগে দলের ঐক্যবদ্ধ চেহারাটি জনতার দরবারে নিয়ে গিয়ে কী করে কংগ্রেস-বিরোধী আন্দোলন করা যায়, তারই রণকৌশল স্থির করতে আডবাণীর বাড়িতে আজ আজ সন্ধ্যায় বৈঠকে বসেছিল এনডিএ। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছে, আগামিকাল থেকেই সংসদে একজোট হয়ে ঝাঁপাবে বিজেপি এবং এনডিএ। লোকসভার বিরোধী দলনেত্রী সুষমা স্বরাজ বলেন, আগামিকালই সংসদে অবৈধ অনুপ্রবেশ ও অসমে হিংসা নিয়ে মুলতুবি প্রস্তাব আনা হবে। বিদ্যুৎ সঙ্কট, খরা, বিদেশি লগ্নি, আর্থিক সঙ্কটের বিষয়গুলি নিয়েও সংসদে সরকারকে কোণঠাসা করবে এনডিএ। এ দিনই অসমে হিংসার প্রতিবাদে দিল্লির যন্তরমন্তরে ধর্নায় বসবেন দলের শীর্ষ নেতারা। সেখানে আডবাণী-সহ গডকড়ী, সুষমা স্বরাজ, অরুণ জেটলিরা অংশ নেওয়ার কথা। |