‘আর্নেস্টো’ না উসেইনকোন ঝড়ের তেজ বেশি?
রবিবার মধ্যরাতের পর এই প্রশ্নটা উঠতেই পারে। মারাত্মক ঝড় ‘আর্নেস্টো’ লন্ডভন্ড করে ছেড়েছে জামাইকাকে। কিন্তু ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের ওই দেশে তেমন তাপ-উত্তাপ কোথায়?
শনশন করে তীব্র হাওয়া বইছে চার দিকে। ঝড়ের তীব্রতা এতটাই যে বাড়ির বাইরে বেরোনো মানে বিপদ ডেকে আনা। কিন্তু তবু রবিবার রাতে রাস্তায় বেড়িয়ে পড়েছেন হাজার হাজার জামাইকান। উসেইন বোল্ট একশো মিটারে সোনা জিততে না জিততে উল্লাসে ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে উল্লাসে ফেটে পড়েছেন শ’য়ে-শ’য়ে বোল্ট-ভক্ত। কেউ অঝোরে কাঁদছেন। কারও মুখে শুধু একটাই চিৎকার, ‘জামাইকা..জামাইকা।’ কেউ আবার আবেগে ডুবে গিয়ে বলছেন, “বোল্ট যখন দৌড়য় তখন গোটা দুনিয়া কাঁপে।” |
কম্পনই বটে! উসেইন বোল্ট না ইওহান ব্লেককে বিশ্বের দ্রুততম ব্যক্তি, তা নিয়ে কম জল্পনা চলেনি অলিম্পিকে। সাম্প্রতিক কালে বোল্টের পারফরম্যান্স ভাল ছিল না। ব্লেকের কাছে হেরেছেন দু’বার। কিন্তু রবিবার রাতে সম্রাট ফের সিংহাসনে। ১০০ মিটার দৌড় শেষ মাত্র ৯.৬৩ সেকেন্ডে। নিজের বিশ্বরেকর্ড ভাঙতে পারেননি বোল্ট। কিন্তু ভেঙে দিয়েছেন নিজেরই অলিম্পিক রেকর্ড (৯.৬৯ সেকেন্ড)। ব্লেকের সেখানে একশো মিটার দৌড় শেষ করতে লাগল বোল্টের চেয়ে ০.১২ সেকেন্ড বেশি! এর পর আর বোল্ট-ভক্তদের রোখে কে?
কোমর দুলছে। ক্যামেরার সামনে মাঝেমাঝেই বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি। কখনও মাথা টিপে ধরে ঝাঁকাচ্ছেন। স্টার্টিং লাইনে পৌঁছে একবার বুকে ‘ক্রস’ আঁকা। তার পর স্বপ্নের দৌড় এবং সোনা জিতে আকাশের দিকে আঙুল তুলে বিশ্বকে বোঝানো, ‘দ্যাখো, আবার ফিরে এসেছি। সম্রাট আবার সিংহাসনে।’
শত মিটার ফাইনালের পরে বাকি প্রতিদ্বন্দ্বীদের স্তব্ধ করে দিয়ে হুঙ্কার দিয়েছেন বোল্ট “আমি বারবার একটা কথা বলেছি। চ্যাম্পিয়নশিপ আসতে দাও। দেখবে উসেইন বোল্ট কী করে।” আসাফা পাওয়েল তখন হতাশায় ডুবে। ব্লেক পর্যন্ত তখন বুকে টেনে নিচ্ছেন নিজের এক নম্বর প্রতিদ্বন্দ্বীকে। আর বোল্ট? কখনও উচ্ছ্বাস। কখনও তাচ্ছিল্য। কখনও বিনয়। নইলে আর বলবেন কেন, “কী করব, এটাই তো আমার কাজ। ভাল প্রস্তুতি নিয়ে আমি এসেছিলাম লন্ডনে। বিশ্বকে দেখিয়ে দিলাম, আমিই সেরা। আজ জেতার পর কী দাঁড়াল? আমি কিংবদন্তি হওয়ার দিকে আরও একধাপ এগোলাম।”
কিন্তু আপনি সর্বকালের সেরা কী? মরিস গ্রিন শরীরে তো একটা উল্কি কেটেছেন। যাতে লেখা: আমিই বিশ্বের সর্বকালের সেরা। বোল্ট নিজে কী মনে করেন? “বলতে পারব না। দু’শো মিটার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তার পরই আমার ভক্তকুল বলতে পারবে বোল্টই সর্বকালের সেরা। তাই দু’শো মিটার রেসের আগে আমি নিজেও কিছু বলতে পারছি না।”
কিন্তু এত কিছু করেও সমালোচনা পিছু ছাড়ছে না বোল্টের। রবিবার রেসে নামার আগে অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি করে দর্শকদের তাতিয়ে দেন বোল্ট। যা নিয়ে বলা হচ্ছে, বোল্ট কেন এটা করলেন। কিন্তু বিশ্বের দ্রুততম মানুষ যিনি, তিনি এ সবে আর পাত্তা দেবেন কেন? পরিষ্কার জানাচ্ছেন, তিনি নিজের উপলব্ধি অনুযায়ী চলবেন। বাকি দুনিয়ার কথায় কান না দিয়ে। আর তাঁর উপলব্ধি বলে, অ্যাথলেটিক্স আসলে বিনোদন।
“আমি এটাই করি সব সময়। সেটা তো বলেছি,” যাবতীয় সমালোচনা ফুৎকারে উড়িয়ে বলেছেন বোল্ট। কিন্তু করেন কেন? এ বার কিংবদন্তির উত্তর, “লোকে আসে আমি কী করলাম সেটা দেখতে। আমি আজ কী করলাম। কাল কী করব। আর ওঁদের কাছে সেটাই বিনোদন।”
আর বিনোদনের উদাহরণ? উত্তর তো জামাইকা। যেখানে আপাতত উসেইনের হাতে ‘খুন’ আর্নেস্টো!
|
শারীরিক গঠন
আগে বলা হত লম্বা হলে গতি বাড়াতে সমস্যা। জামাইকার উসেইন বোল্ট এই তত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করেছেন। ছ’ফুট পাঁচ ইঞ্চি লম্বা হওয়ায় একশো মিটার শেষ করতে তাঁর কম ‘স্ট্রাইড’ লাগে। ব্লেকের যেখানে ৪৬ বার পা ফেলতে হয়েছিল, বোল্ট ফেলেন ৪১। যা সব চেয়ে কম।
শক্তি
অসম্ভব শারীরিক সক্ষমতা এবং নমনীয়তার জন্য প্রতিটা পদক্ষেপে পেশি শক্তির অবিশ্বাস্য বিস্ফোরণ ঘটাতে পারেন বোল্ট। সঙ্গে নিজের প্রতিটা পদক্ষেপকে ‘স্ট্রেচ’ করতে পারেন অনেকটা। ক্রীড়াবিজ্ঞানী ডা. রস টাকার বলেছেন, “এ রকম ইলাস্টিক রানার আগে দেখিনি।”
স্টার্ট
বোল্ট সাধারণত নিজের স্টার্ট নিয়ে চিন্তায় থাকেন। কিন্তু অলিম্পিক ফাইনালে স্টার্টিং ব্লকে বোল্টের রিঅ্যাকশন টাইম ছিল .১৬৫ সেকেন্ড। সেখানে ব্লেক এবং গ্যাটলিনের যথাক্রমে .১৭৯ সেকেন্ড এবং .১৭৮ সেকেন্ড।
জিম
শরীরের প্রকৃতিদত্ত ক্ষমতাকে পুরো বাড়তে দেবেন বলে ১৮ বছরের আগে জিমে ওজন তোলেননি। এখন প্রধানত করেন ‘স্ট্রেংথ এবং এনডিওরেন্স’ ট্রেনিং।
ডায়েট
দিনে ছ’বার খান বোল্ট। খাদ্য তালিকায় ৬০ শতাংশ প্রোটিন, ৩০ শতাংশ কার্বোহাইড্রেট, ১০ শতাংশ ফ্যাটস।
ব্রেকফাস্ট: জামাইকান ডাম্পলিংস এবং মেটে আলু, রাঙা আলু।
লাঞ্চ: টুনা, হোল হুইট ব্রেড, ব্রাউন রাইস।
ডিনার: ব্রাউন রাইসের সঙ্গে চিকেন, পর্ক বা বিফ। সারা দিনে প্রচুর পানীয়, বিশেষ করে গ্যাটোরেডের সঙ্গে জল মিশিয়ে।
বোল্টের থেকে দ্রুত
এ বছর ২০ জুন সিনসিনাটি চিড়িয়াখানায় একশো মিটার দৌড় করানো হয়েছিল সারাকে। ৫.৯৫ সেকেন্ডে একশো মিটার দৌড়য় সারা। তবে সারা কোনও মানুষ নয়, একটি ১১ বছরের মেয়ে চিতা।
|
বোল্টের ৯.৬৩ সেকেন্ডে সোনা জয়ের দৌড়ের সঙ্গে অলিম্পিকের একশো মিটার দৌড়ের ইতিহাসে সোনাজয়ীদের তুলনা করলে বেরিয়ে আসছে মানুষ কী ভাবে কমিয়ে আনছে সময়।
বোল্ট যখন ফিনিশিং লাইনে, তখন অতীতের অলিম্পিক সোনাজয়ী স্প্রিন্টাররা কোথায় থাকতেন:
১৯১২ র্যালফ ক্রেগ (সময় ১০.৮ সে.): ৮৯.১৭ মি.
১৯২৪ হ্যারল্ড অ্যাব্রাহামস (১০.৬ সে.) ৯০.৮৫ মি.
১৯৩৬ জেসি ওয়েন্স (১০.৩ সে.) ৯৩.৫ মি.
১৯৬০ আমিন হ্যারি (১০.২ সে.) ৯৪.৪১ মি.
১৯৬৮ জিম হাইন্স (৯.৯৫ সে.) ৯৬.৭৮ মি.
১৯৮৮ কার্ল লুইস (৯.৯২ সে.) ৯৭.০৮ মি.
১৯৯৬ ডোনোভান বেইলি (৯.৮৪ সে.) ৯৭.৮৭ মি. |