প্রবন্ধ ১...
বেনিতো মুসোলিনির প্রতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
খনও রহিল বাধা।
দেড়শো পার হতে চলল। প্রাতিষ্ঠানিক রবীন্দ্রসংস্কার মুক্তির পথে এখনও সাহসী হতে পারল না বিশ্বভারতী। গতকাল, সোমবার শান্তিনিকেতনে রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন সাধারণের জন্য খুলে দিলেন নবসজ্জিত রবীন্দ্রভবনের দরজা। কিন্তু ভালমন্দ মেশানো যে সত্য রবীন্দ্রনাথ সেই ভবনে ‘সংরক্ষিত’ হয়ে আছেন তাঁর দরজা খুলল কি?
প্রশ্নটি উঠছে। কারণ গত কালই প্রায় সাত দশক দুর্লভ থাকার পরে পুনঃপ্রকাশিত হল রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্র-এর দ্বিতীয় খণ্ড। ১৩৪৯ বঙ্গাব্দের আষাঢ়ে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠির এই সংকলন। তার পরে দীর্ঘ ৭০ বছরে দ্বিতীয় বার মুদ্রিত হয়নি সে বই। সে-সংকলনের কয়েকটি কপিতে ছিল ২১ নভেম্বর ১৯৩০ তারিখে পুত্রকে লেখা একটি চিঠি, যার শেষের দিকে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন,
‘Prof. Formichi এসেছিলেন। এখনো আমাদের উপরে তাঁর আন্তরিক টান আছে। আমার সঙ্গে দেখা হতেই তাঁর চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলুম ইটালি দিয়ে আমার যাওয়া চলবে কিনা। তিনি বললেন মুসোলিনিকে একখানা চিঠি লিখ্লেই সমস্ত জঞ্জাল সাফ হয়ে যায়। আমি তাঁকে বলেচি, চিঠি লিখব। চিঠিটা এইসঙ্গে পাঠাই। যদি দ্বিধার কারণ না থাকে পাঠিয়ে দিস। চিরকাল ইটালির সঙ্গে ঝগড়া জাগিয়ে রাখা ঠিক নয়।’
মুসোলিনি। রবীন্দ্রচিত্রাবলি, বিশ্ব-ভারতী ও প্রতিক্ষণ
‘সমস্ত জঞ্জাল’ মানে রবীন্দ্রনাথ ও ইতালির সর্বশক্তিমান ফাসিস্ত নায়ক ‘ইল দুচে’ বেনিতো মুসোলিনির সম্পর্ক ঘিরে বিতর্ক। ১৯২৫-এর শেষ দিকে মুসোলিনি ইতালীয় সাহিত্যের বিপুল সম্ভার-সহ অধ্যাপক জিওসেপ্পে তুচ্চি ও ফর্মিকিকে বিশ্বভারতীতে অধ্যাপনার জন্য পাঠান। ১৯২৬-এ রোমে মুসোলিনির সঙ্গে দেখা করে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন রবীন্দ্রনাথ। স্বভাবতই, তার ফলে বিতর্ক তৈরি হয়। পরে রম্যাঁ রোলাঁ ফাসিস্ত মুসোলিনির সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথকে জানান। ফাসিস্ত ইতালির বিরুদ্ধে অ্যান্ড্রুজকে লেখা খোলা চিঠি প্রকাশিত হয় ‘ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান’ পত্রিকায়। তার বিরুদ্ধে মুসোলিনির নিজস্ব পত্রিকা ‘পোপোলো দ’ইতালিয়া’ রবীন্দ্রনাথকে ‘তৈলাক্ত ও অসহ্য লোক’, ‘অসৎ তাতর্ুযফ’ ইত্যাদি বলে রীতিমত ব্যক্তি-আক্রমণে নামে। পরে রবীন্দ্রনাথ বহু সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, মুসোলিনির ওই উচ্ছ্বসিত প্রশংসা তিনি না-জেনেই করেছিলেন। কিন্তু তার চার বছর পরে, ঝগড়া মেটাতে চেয়ে মুসোলিনিকে তিনিই লিখলেন,
Il Duce
Signor Mussolini
1172 Park Avenue
New York
Nov. 21, 1930
Your Excellency
It often comes to my memory how we were startled by the magnanimous token of your sympathy reaching us through my very dear friend Prof Formichi. The precious gift, the library of Italian literature, is a treasure to us highly prized by our institution and for which we are deeply grateful to Your Excellency.
I am also personally indebted to you for the lavish generosity you showed to me in your hospitality when I was your guest in Italy and I earnestly hope that the misunderstanding which has unfortunately caused a barrier between me and the great people you represent, the people for whom I have genuine love, will not remain permanent, and that this expression of my gratitude to you and your nation will be accepted. The politics of a country is its own; its culture belongs to all humanity. My mission is to acknowledge all that has eternal value in the self-expression of any country. Your Excellency has nobly offered to our institution in behalf of Italy the opportunity of a festival of spirit which will remain inexhaustible and ever claim our homage of a cordial admiration.
I am, Your Excellency,
Gratefully Yours...
Rabindranath Tagore
চিঠিটা পাঠানো হয়েছিল, এবং সেটা মুসোলিনির হাতে পৌঁছেছিলও। অথচ এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চিঠিটি, অতি প্রাসঙ্গিক হওয়া সত্ত্বেও, চিঠিপত্র ২-এর সাম্প্রতিক সংস্করণে দেওয়া গেল না। অবশ্য রথীন্দ্রনাথকে লেখা চিঠিটি স্থান পেয়েছে এই ‘সংশোধিত’ সংস্করণে। রবীন্দ্রভবন আর্কাইভ-এর মুসোলিনি ফাইলে মুসোলিনিকে লেখা চিঠিটি আছে। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর সাত দশক পরেও সে চিঠি চিঠিপত্রে ছাপানো গেল না কেন? ওই চিঠির সাক্ষ্যেই কি প্রমাণ হয়ে যাবে, ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’-র কবি ফাসিস্ত-বন্ধু? না, এমন আহাম্মকের মতো কথা নিশ্চয় কেউ বলবেন না। বিশেষ করে আরও বছর চারেক পরেই দেখা যাবে মুসোলিনির ব্যঙ্গচিত্র আঁকছেন রবীন্দ্রনাথ (সঙ্গের ছবি)। তারও পরে বলবেন ‘সভ্যতার সংকট’।
কিন্তু ওই চিঠিটাই দেবতা জেনে দূরে দাঁড় করানো রবীন্দ্রনাথকে অনেক কাছে এনে দিত আমাদের। দ্বিধাগ্রস্ত, রক্তমাংসের একটা মানুষকে, বার বার নিজেকে বদলে চলা এক জন স্রষ্টাকে আরও কাছ থেকে দেখার মূল্যবান সহায়ক ওই চিঠি। যে-রবীন্দ্রনাথ ‘দেনাপাওনা’র মতো গল্প লিখেও নিজের মেয়ের বিয়ে দিতে বাধ্য হন মোটা পণ দিয়ে, যে-রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীর জন্য অর্থসংগ্রহ করতে গিয়ে বহু বার নানা আপসের রাস্তা বেছে নেন, যে-রবীন্দ্রনাথ প্রিয়ম্বদা দেবীর কবিতা নিজের বলে ‘ভুল’ করে লেখন-এ নিয়েও পরে যথেষ্ট আড়াল রেখে সে ভুল স্বীকার করেন, সেই রবীন্দ্রনাথকে নতুন করে আবিষ্কারই তো এই সার্ধশতবর্ষের বড় কাজ হওয়া উচিত ছিল।
কিন্তু সেই রবীন্দ্রনাথকে আড়াল করার আশ্রমিক চেষ্টাটা হয়েই চলেছে। ১৯৪২-এ প্রথম যখন প্রকাশিত হয় চিঠিপত্রের দ্বিতীয় খণ্ড, তখন কয়েকটা কপিতে চিঠিটা বেরিয়ে গিয়েছে দেখে তড়িঘড়ি বদলে ফেলা হয় বই। তার ফলে তৈরি হয় একটা ধাঁধা। শঙ্খ ঘোষ লিখেছেন সেই ধাঁধা-র গল্পটা, তাঁর বইয়ের ঘর-এ: ‘আমার বইয়ের ১০৯-১০ পৃষ্ঠায় যে-চিঠি ছাপা আছে, আর তার সঙ্গে ১০৬-০৯ পৃষ্ঠায় রথীন্দ্রনাথকে লেখা তাঁর যে কথাগুলি তা একেবারে ‘নেই’ হয়ে গেল, অথচ পৃষ্ঠাসংখ্যা রইল ঠিকঠাক? পরিষদের সে-বইও তো প্রথম সংস্করণের, কেননা ১৯৪২ সালের পরে তখনও পর্যন্ত (এবং আজও পর্যন্ত) সে-বইয়ের তো কোনো মুদ্রণই হয়নি আর! পরে খোঁজ নিয়ে দেখি, ঠিকই, কোনো কপিতেই পাচ্ছি না সেই চিঠি, এমনকী রবীন্দ্রভবনের কপিতেও না। তার মানে, বইটি ছাপা হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চয় কারও চোখে পড়ে যায় অনেকের কাছে অনভিপ্রেত ওই চিঠিখানা, পরিকল্পিতভাবেই পালটে ফেলা হয় তাকে, কেবল অগ্রিম-বাঁধিয়ে-ফেলা ইতস্তত কয়েকখানা বই হয়তো ছিটকে যায় এধার-ওধার...’
মুসোলিনির সঙ্গে ‘দুর্ভাগ্যবশত’ ঘটে যাওয়া ‘ভুল বোঝাবুঝি’র অবসান চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তার কারণ হয়তো বিশ্বভারতী-র জন্য অর্থসংগ্রহের তাগিদ। কিন্তু ওই চিঠিতেই আর একটা কথাও লিখেছেন তিনি: একটা দেশের রাজনীতি তার নিজস্ব, সংস্কৃতি বিশ্বমানবতার। আর তাঁর লক্ষ্য, কোনও দেশের আত্ম-প্রকাশে যা-কিছুর শাশ্বত মূল্য আছে তাকেই স্বীকৃতি দেওয়া।
এ কি রবীন্দ্রনাথের মুক্তচিন্তা? না কি, প্রচ্ছন্ন বিবেক-সান্ত্বনা? এই প্রশ্নটা নিয়ে তর্কের সুযোগও কি পূজার ছলে আঁধারেই রয়ে যাবে? সার্ধশতবর্ষ পরেও?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.