ফেব্রুয়ারিতে ওহায়ো, মার্চে ফ্লোরিডা, এপ্রিলে ক্যালিফোর্নিয়া, জুলাইয়ে কলোরাডো, অগস্টে উইসকনসিন। কীসের তালিকা? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নামক দেশটিতে ২০১২ সালের বন্দুকে যথেচ্ছ গণহত্যার হিসাব এই তালিকায়। একমাত্র শেষতম ঘটনাটি যাহা গত সপ্তাহান্তে উইসকনসিন প্রদেশের একটি গুরুদ্বারে ঘটিয়াছে তাহার পিছনে একটি আন্তঃ-সাম্প্রদায়িক হিংসার প্রমাণ মিলিলেও মিলিতে পারে। বাকি ক্ষেত্রগুলি কিন্তু সম্পূর্ণ আকস্মিক এলোপাথাড়ি হিংসার তাণ্ডব, যে তাণ্ডবে মনোজাগতিক বিকলনের চিহ্ন স্পষ্ট। মনে রাখিতে হইবে, ইহা কেবলই চলমান বৎসরের প্রথমার্ধের চিত্র। শতাব্দীর প্রথম দশকটির হিসাব লইলে চিত্রটির ভয়াবহতা আরওই প্রবল হইয়া উঠিবে, সন্দেহ নাই। অর্থাৎ মার্কিন রাজনীতিকগণ যতই বিশ্বময় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কোমর বাঁধিয়া নামিয়া পড়ুন না কেন, মার্কিন নাগরিকদের শত্রু কেবল দেশসীমান্তের বাহিরেই নাই, সীমান্তের অভ্যন্তরেও যথেষ্ট পরিমাণে ছড়াইয়া রহিয়াছে, এবং তাঁহাদের শত্রু কেবল ভিন্দেশি কিংবা ভিন্-সম্প্রদায়ের মধ্যেই নাই, ‘নিজ’ সম্প্রদায় বলিতে তাঁহারা যাহা বোঝেন, তাহার মধ্যেও রহিয়াছে। সুতরাং, হিংসা বস্তুটিকে কোনও আদর্শ-উদ্দেশ্যের তত্ত্বে বাঁধিতে তাঁহারা আপাতত বড়ই বেগ পাইতেছেন, তাই উপায়ান্তর না দেখিয়া মনস্তত্ত্বে মনোনিবেশ করিয়াছেন। মুশকিল হইল, তত্ত্ব হইতে যেমন বাঁধাধরা নীতিতে পৌঁছনো যায়, মনস্তত্ত্ব হইতে সেই পদ্ধতিতে নীতি-নির্ধারণ কিন্তু ভারী কঠিন কাজ। তাই মুসলিম সন্ত্রাসবাদীর হানা-পরিকল্পনা ব্যর্থ হইলেও ইরাক ও ইয়েমেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধবরাদ্দ বাড়ে, কিন্তু নিজের দেশের বন্দুকবাজ পঞ্চাশ জনকে মারিলেও অন্তরিন চিকিৎসার সতর্ক প্রতিশ্রুতি শোনা যায়।
নীতির সূত্রেই আসিয়া পড়ে অস্ত্র-নিয়ন্ত্রণের নীতির কথা। মার্কিন সমাজ এই মূহূর্তে পশ্চিমি উন্নত দেশগুলির মধ্যে একমাত্র যাহার অস্ত্র-নিয়ন্ত্রণ আইন এতটা শিথিল। ডেমোক্র্যাট কিংবা রিপাবলিকান দুই শিবিরের নীতি এ বিষয়ে পৃথক ঠিকই, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কোনও পক্ষেরই এই আইনধারার বিপরীতে যাইবার আগ্রহ বা ক্ষমতা নাই। রিপাবলিকান রাজনীতিকরা ব্যক্তি-স্বাধীনতার দোহাইয়ে এই নিয়ন্ত্রণে উৎসাহী নন। আর নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করিয়াও রাজনৈতিক (ও অর্থনৈতিক) বাধ্যবাধকতার চাপে ডেমোক্র্যাটদের পক্ষেও বেশি দূর পদক্ষেপণ কঠিন কেননা বন্দুক-লবির অর্থ ওয়াশিংটন ডিসি-র রাজনীতির বিশেষ পৃষ্ঠপোষক। প্রেসিডেন্ট নির্বাচন দুয়ারে আসিয়া পড়া সত্ত্বেও যে প্রেসিডেন্ট ওবামা এ বিষয়ে খানিক মুখ খুলিলেন, বন্দুক-নিয়ন্ত্রণের কাজটির গুরুত্বটুকু অন্তত উচ্চারণ করিলেন, ইহা লইয়াই হিংসা-তাণ্ডবে নিহত কয়েক শত মার্কিন নাগরিকের পরিজনদের সন্তুষ্ট থাকিতে হইবে। সর্বক্ষমতাসম্পন্ন ‘লবি’ আর বেশি দূর এগোতে দিবে না।
ইত্যবকাশে দু’-একটি গুরুতর কথা। নিজেদের দেশে যাঁহারা হিংসার কারবারি, তাঁহারা মনোবিকলনের রোগী, এবং অপরাপর দেশে বা সম্প্রদায়ে যাঁহারা মার্কিনিদের বিরুদ্ধে হিংসার কারবার করেন, তাঁহারা সেই বিশেষ দেশ ও সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিস্বরূপ, এই সহজসরল যুক্তিধারা হইতে মার্কিনিদের দ্রুত বাহির হওয়া উচিত। নিজের দেশের বন্দুকবাজদের জন্য যদি পাল্টা হিংসার বদলে চিকিৎসার নিদান ভাবা হয়, তবে ৯/১১-র হিংসাবাজদের জন্য কেন দশ বৎসরের মারণ-যজ্ঞ, তাহারও পুনর্বিবেচনা দরকার। হিংসা একটি বিকার, যাহার সমাধানের জন্য বৌদ্ধিক ও মানবিক পথসন্ধান চাই। কেবল সামরিক পথসন্ধানই সম্ভবত যথেষ্ট নয়। |