সরকারি ডাক্তারদের গ্রামে যেতে আগ্রহী করতে স্নাতকোত্তরের প্রবেশিকায় ৩০% বাড়তি নম্বরের ‘টোপ।’ তা নিয়ে বিতর্ক, মামলা। যার জেরে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরির প্রক্রিয়াটাই দস্তুরমতো ধাক্কা খেয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। অদূর ভবিষ্যতে সরকারি বিশেষজ্ঞ-চিকিৎসকের অভাব আরও প্রকট হয়ে ওঠার আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে। স্বাস্থ্য দফতর অবশ্য সঙ্কটের দায় নিতে নারাজ।
রাজ্য সরকার ঘোষণা করেছিল, ‘দুর্গম বা উপদ্রুত’ অঞ্চলে টানা তিন বছর কাজ করে এলে সরকারি ডাক্তারদের এমডি-এমএসের প্রবেশিকায় ৩০% বাড়তি নম্বর মিলবে। কিন্তু গোল বাঁধে ‘দুর্গম বা উপদ্রুত’ এলাকার তালিকা নিয়ে। সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে দেখা যায়, কলকাতার বাঙুর বা বাঘাযতীন হাসপাতালের অবস্থান ‘দুর্গম ও উপদ্রুত’ এলাকায়! অথচ করিমপুর বা ফাঁসিদেওয়া যাতায়াতের পক্ষে ‘সুগম’ হিসেবে চিহ্নিত! এমনকী উত্তর ২৪ পরগনা, নদিয়া, বা শিলিগুড়ি মহকুমার কোনও হাসপাতাল ‘দুর্গম বা উপদ্রুত’ তালিকায় ঠাঁই না-পেলেও বহরমপুর, মালদহ, ডায়মন্ড হারবার, মেদিনীপুর হাসপাতালের ডাক্তারেরা দুর্গম’ অঞ্চলে কাজ করার সুবাদে ৩০% নম্বর বেশি পাবেন!
এ হেন ‘বৈষম্যমূলক ও বিভ্রান্তিকর’ বিজ্ঞপ্তিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন একদল চিকিৎসক। এ দিকে রাজ্যে এমডি-এমএসের ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছে গত জুনে। কিন্তু আদালতে বিতর্কটির ফয়সালা না-হওয়ায় এক জন সরকারি ডাক্তারও স্নাতকোত্তরে ভর্তি হতে পারেননি। তাই চলতি শিক্ষাবর্ষে এমডি-এমএসে আড়াইশোরও বেশি ‘দুষ্প্রাপ্য’ আসন ফাঁকা পড়ে রয়েছে! যে রাজ্যে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের এত আকাল, সেখানে এমন পরিস্থিতি সমস্যাকে জটিলতর করে তুলবে বলে চিকিৎসক মহলের একাংশের আশঙ্কা। সরকারি ডাক্তারদের অনেকের মতে, উদ্যোগটি ঠিকই ছিল। |
স্রেফ তাড়াহুড়ো করে ‘দুর্গম’ অঞ্চলের তালিকা বানাতে গিয়ে যে ভুল হয়েছে, সেটাই গোটা প্রয়াসে জল ঢেলে দিয়েছে। আর সেই ভুল সংশোধনের বদলে দু’বছরের ডিপ্লোমা বা এক বছরের সার্টিফিকেট কোর্স চালু করে বিশেষজ্ঞ তৈরির চেষ্টাও আর একটা ভুল বলে তাঁদের অভিমত।
সরকারের কী বক্তব্য?
স্বাস্থ্য-কর্তারা অবশ্য পরিস্থিতির দায় নিতে চাইছেন না। স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “আমাদের এখন কিছু করার নেই। যা বলার, কোর্ট বলবে। আমরা চেষ্টা করেছিলাম, হয়নি।” রাজ্য স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ উপাচার্য মৃণালকান্তি চট্টোপাধ্যায়ের দাবি: তাঁরা দু’দফায় সরকারি ডাক্তারদের কাউন্সেলিংও করেছিলেন, তবু উদ্যোগটি আর এগোয়নি। তা হলে কি ৩০% বাড়তি নম্বর দেওয়ার সিদ্ধান্তেই ভুল ছিল?
মৃণালবাবুর ব্যাখ্যা, “এমসিআইয়ের নিয়মেও ৩০% নম্বর দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে ব্যাপারটা এমন দাঁড়াবে, বোঝা যায়নি। এর পরে কী হবে জানি না।” কিন্তু প্রশ্ন হল, ‘বিভ্রান্তিকর’ তালিকা তো এমসিআই তৈরি করেনি! করেছে স্বাস্থ্য দফতর। সে ক্ষেত্রে তারা দায় নেবে না কেন?
স্বাস্থ্য-কর্তাদের কাছে এর সদুত্তর মেলেনি। যদিও ‘দুর্গম’ ও ‘উপদ্রুত’ এলাকার সংজ্ঞা নিয়ে যাঁরা মামলা করেছেন, তাঁরা দফতরের বিরুদ্ধে বৈষম্যের অভিযোগও তুলেছেন। তাঁদের বক্তব্য: কোন সরকারি ডাক্তারকে কোথায় নিয়োগ বা বদলি করা হবে, স্বাস্থ্য দফতরই তা ঠিক করে। অর্থাৎ ‘দুর্গম বা উপদ্রুত’ এলাকায় কাজের সুযোগ পাওয়া বা না-পাওয়ায় নিজেদের ভূমিকা না-থাকা সত্ত্বেও সরকারি ডাক্তারেরা কেউ স্নাতকোত্তর প্রবেশিকায় বাড়তি নম্বর পাবেন, কেউ পাবেন না। এটা সম্পূর্ণ নীতিবিরুদ্ধ বলে মামলাকারীদের দাবি।
এখন তা হলে উপায় কী?
স্নাতকোত্তরে ভর্তির অপেক্ষায় থাকা সরকারি চিকিৎসকদের বড় অংশ জানাচ্ছেন, তাঁদের শেষ সহায় সুপ্রিম কোর্টের একটি নির্দেশ। যাতে বলা হয়েছে, ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে শিক্ষা সংক্রান্ত যাবতীয় ভর্তির প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। তার মধ্যে হাইকোর্টে বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়ে গেলে চলতি শিক্ষাবর্ষে এমডি-এমএসের ক্লাস শুরু করার একটা সুযোগ মিললেও মিলতে পারে বলে ওঁদের আশা।
আপাতত আশাই ভরসা। |