প্রবন্ধ...
হা-আ-আ-ই
দালত কক্ষে এক আইনজীবীর হাই তোলা খবর হয়েছিল কিছু দিন আগে। ঘটনাটি এ রকম: পুরোদমে চলছিল এক মামলার শুনানি। তার মধ্যে হঠাৎ হাই তুললেন আইনজীবী। শব্দ সহযোগে। শুনে হেসে ফেললেন অন্য আইনজীবীরা। তাতেই ক্ষুব্ধ বিচারক। ক্ষোভের কারণ, এক জন আইনজীবীর ব্যাখ্যা, ‘সম্ভবত বিদ্রুপ করা হচ্ছে বলে ভুল বোঝেন বিচারক।’ বিচারকের বোঝার ‘ভুল’ হয় কি-না তা জানা নেই, তবে অতঃপর আইনজীবীদের সমালোচনা করেন বিচারক। এবং এ বার ক্ষুব্ধ হন আইনজীবীরা। বার কাউন্সিলের বৈঠক ডাকেন। বিচারকের এজলাসে বয়কট করেন দু’দিন। পরিস্থিতির মোকাবিলায় প্রয়োজন হয় কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির হস্তক্ষেপ। কোথায় গড়াল কোথাকার জল! সামান্য এক হাই থেকে কত কী! ভাগ্যিস সুকুমার রায় আর নেই, নইলে...।
নাহ্, ‘আবোল তাবোল’-এর স্রষ্টা, মনে হয়, সন্তুষ্ট হতেন না এ বিষয়ে কোনও ননসেন্স পদ্যে। বরং বিষয়ের গভীরতা বিবেচনা করে হাত দিতেন কোনও প্রবন্ধ রচনায়। যেমন প্রবন্ধ অনেক লিখেছেন তিনি। বহু-পরিচিত না হলেও সেগুলি সুকুমার-সুলভ রচনাশৈলীতে উজ্জ্বল। হাই-এর তাৎপর্য সন্ধানে বিজ্ঞানের গবেষণা এত ব্যস্ত যে, তা লজ্জা দেয় আপাত-তুচ্ছ ওই প্রবৃত্তিটিকে। হাসির রাজা এই বৈপরীত্যে অবশ্যই আকৃষ্ট হতেন।
চারিত্রিক উপসর্গ হিসেবে হাই লক্ষণটা কেবল মানুষের একান্ত নয়, বহু প্রাণীর মধ্যে বিস্তৃত। স্তন্যপায়ী এবং অধিকাংশ মেরুদণ্ডী প্রাণী হাই তোলে। মাছ, কচ্ছপ, কুমির, পাখি এমনকী সাপও। কিছু পেঙ্গুইনের কাছে হাই তোলাটা আবার যৌনতার দামি অনুষঙ্গ। মানবশিশু হাই তোলে মাতৃ জঠরেও। যে সব প্রাণীর কথা বলেছি, তাদের মধ্যে এ অভ্যেস আদিম, লক্ষ লক্ষ বছরের প্রাচীন।
অথচ তা নিয়ে গবেষণার ট্রাডিশন মাত্র তিরিশ-পঁয়তিরিশ বছরের ব্যাপার। কেন? জবাব দিয়েছেন রবার্ট প্রোভাইন। মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটির সেই প্রফেসর, যিনি হাই গবেষণায় উল্লেখযোগ্য। তিনি লিখেছেন, ‘১৯৮০-র দশকে যখন এ ব্যাপারে গবেষণায় নামি, তখন ছাত্রদের বিষয়টার গুরুত্ব বোঝাতে গলদঘর্ম হতাম।’ বিজ্ঞানচর্চা বলতে ছাত্রদের ধারণা হল দামি দামি যন্ত্রপাতি, মোটা মোটা আর্থিক অনুদান, গুরুগম্ভীর বিষয় ইত্যাদি। সে তুলনায় হাই ব্যাপারটা তুচ্ছ বইকী। স্টপ ওয়াচ, নোটপ্যাড এবং পেনসিল হাতে নিয়ে এর গবেষণায় নামা যায়। অথচ, তার পর কিন্তু ধীরে ধীরে এগোনো যায় অনেক দূর। অন্বেষণ করা যায় মানুষ বা অন্য প্রাণীর বিবিধ আচরণের মূলে স্নায়ুর ভূমিকা। নতুন আলো ফেলা যায় অটিজম কিংবা স্কিৎজোফ্রেনিয়া-র মতো ব্যাধি বিষয়েও। হাই গবেষণার সূত্রে এই যে সহজে ঢুকে পড়া যায় স্নায়ুবিজ্ঞানে, এর জন্য প্রোভাইন একে বলেছেন ‘সাইডওয়াক নিউরোসায়েন্স’। ফুটপাথের (অর্থাৎ সহজলভ্য) স্নায়ু গবেষণা।
হাই নিয়ে গবেষণাকে বিজ্ঞানীরা ফেলেছেন সেই বিভাগে, যার পোশাকি নাম ইথলজি। প্রাণীদের আচরণ অনুধাবনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা যার অন্তর্গত। মানুষের বেলায় হাই চালু থাকে গড়ে ৬ সেকেন্ড; অন্য জীবজন্তুর ক্ষেত্রে মাত্র ৩ সেকেন্ড। হাই তোলা অনেকটা হাঁচির মতন ব্যাপার। একবার পেলে এড়ানো কঠিন।
কেন ওঠে হাই? কী তার উৎস? দৈহিক কী কী ক্রিয়ায় তা এগোয়? এ সব প্রশ্নের পূর্ণাঙ্গ উত্তর মেলেনি এখনও। তবে, কিছু গবেষকের দাবি, তাঁরা খুঁজে পেয়েছেন মস্তিষ্কের সেই অংশ, যা নিয়ন্ত্রণ করে হাই। ওটা নাকি হাইপোথ্যালামাস-এর প্যারাভেনট্রিকুলার নিউক্লিয়াস (পি ভি এন)। ওই পি ভি এন সাইজে এত ছোট যে মস্তিষ্কের ক্রিয়া বোঝার কাজে ব্যবহৃত এম আর আই স্ক্যান ওই অংশের কাজ ভাল বুঝতে পারে না। তা হোক, তবু শনাক্ত করা গেছে হাই ওঠার মূলে বেশ কিছু রাসায়নিক পদার্থ। যেমন, ডোপামাইন, অ্যাসিটাইলকোলিন, গ্লুটামেট, সেরোটোনিন, নাইট্রিক অক্সাইড, অক্সিটোসিন ইত্যাদি।
খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে চিকিৎসক হিপোক্রেটস অনুমান করেছিলেন, হাই তুলে মানুষ ফুসফুস থেকে বের করে দূষিত বাতাস। সেই তত্ত্ব ছিল বহুকাল। পণ্ডিতেরা ভাবতেন, রক্তে বা মস্তিষ্কে দূষিত বায়ু অর্থাৎ, কার্বন ডাই-অক্সাইড বাড়লে এবং বিশুদ্ধ বায়ু মানে, অক্সিজেন কমলে হাই ওঠে। এ তত্ত্ব টেকেনি পরে। দেখা গেছে, দৌড়ঝাঁপ করার সময় (যখন রক্তে অক্সিজেন কমে) মানুষ হাই তোলে না বেশি। তোলে বরং আলসেমির সময়।
অভ্যেস হিসেবে হাই তোলা নিতান্ত প্রাচীন এই বিশ্বাস গবেষকদের মনে উসকে দিয়েছে একটা চিন্তা। প্রাণিরাজ্যে কোনও কিছুই টেকে না, যদি না তা প্রাণীকে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে বেঁচে থাকায় সাহায্য করে। চার্লস ডারউইন-প্রবর্তিত বিবর্তনবাদ অনুযায়ী, যা যা বেঁচে থাকার অন্তরায়, তা মুছে যায়। মানুষ বা অন্য কিছু প্রাণী যে এখনও হাই তোলে, তাতে প্রমাণ হয় ওই অভ্যেস বিবর্তন প্রক্রিয়ায় উপকারী ভূমিকা পালন করেছে। কী ভাবে? উত্তর খুঁজতে বিজ্ঞানীরা তাকাচ্ছেন ওই অভ্যেসের সবচেয়ে মজার দিকে।
হ্যাঁ, অভিজ্ঞতা থেকে আমরা সবাই জানি, হাই বড় ছোঁয়াচে। পাশাপাশি বসে কয়েকজন। একজন হাই তুলল যেমনই, তো বাকি সবাই একে একে তুলবে। সিংহ বাদে অনেক প্রাণীর মধ্যেই এ রকম ছোঁয়াচে হাই ছড়ায়। কী ভাবে ছড়ায়? মানুষের ক্ষেত্রে এ নিয়ে পরীক্ষা হয়েছে বিস্তর। দেখা গেছে, অন্যের হাই তোলার ছবি দেখেও হাই ওঠে। কী উসকে দেয় ছোঁয়াচ? খোঁজ নিতে গিয়ে গবেষকরা জেনেছেন, এ ব্যাপারে জড়িত মস্তিষ্কের সেই সব অংশ, যাদের মিলিত কাজের উপহার মানুষে-মানুষে সহমর্মিতা। বিজ্ঞানে যার অর্থ অন্যের সুখ-দুঃখ নিজে অনুভব করার ক্ষমতা। অটিজম বা স্কিৎজোফ্রেনিয়ার রুগিদের ওই ক্ষমতা কম। তাই অন্যের হাই তোলা দেখে ওদের হাই ওঠে না।
এ সবের সঙ্গে বিবর্তনের সম্পর্ক? আছে। গত বছর আমেরিকায় এমোরি ইউনিভার্সিটির দুই বিজ্ঞানী ম্যাথু ক্যাম্পবেল এবং ফ্রান্স ডি ওয়াল ছোঁয়াচে হাই পরীক্ষা করেছিলেন শিম্পাঞ্জির মধ্যে। দেখেছিলেন, আই-পডে চেনা শিম্পাঞ্জির হাই তোলার ছবি দেখে অন্য শিম্পাঞ্জি যত হাই তোলে, অচেনার ছবি দেখে ততটা তোলে না। মানুষের বেলায় এমনটা হয় না। পরিচিত বা অপরিচিতের হাই মানুষের মধ্যে সমান ভাবে ছড়ায়। ক্যাম্পবেল এবং ডি ওয়াল-এর সিদ্ধান্ত: বিবর্তনের পথে মানুষ অনেক আগে অপরিচিতকে আপন করে নিয়েছে। হয়তো এতে বিবর্তনে বাড়তি সুবিধে হয়েছে তার।
হাই নিয়ে হট্টগোলে এ সব প্রসঙ্গ এসেছে কি? মনে হয় না।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.