নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে লস অ্যাঞ্জেলেসের বাড়িতে, ৮৬ বছর বয়সে মারা গেলেন গোর ভাইডাল। লেখক, চিত্রনাট্যকার, অভিনেতা, টক শো হোস্ট, রাজনীতিক এবং কাউকে পরোয়া না করা কথাবার্তা...ছয় অবতারেই তিনি সাড়া জাগিয়েছিলেন দুনিয়ায়।
শেষ বেপরোয়া কথা ছিল ১১ বছর আগে। বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্রে ৯/১১-র বিমানহানার পরে এই মার্কিন লেখক বুশ প্রশাসনকে ‘অদক্ষ, অপদার্থ’ ইত্যাদি বলে গাল পেড়েছিলেন। গালমন্দ এমনই ছিল যে, বিখ্যাত এক পত্রিকা গোরের লেখা ছাপতে অস্বীকার করে। কিন্তু গোরের জীবনে সে আর নতুন কী! দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে, ‘দ্য সিটি অ্যান্ড দ্য পিলার’ উপন্যাস তাঁকে খ্যাতির চুড়োয় পৌঁছে দেয়। সমকামিতা অবৈধ, এমন একটি দেশে প্রতিবাদী আন্দোলনে রয়েছে সেই উপন্যাসের নায়ক।
|
গোর ভাইডাল
(১৯২৫-২০১২) |
তখনকার যুবকযুবতীদের মধ্যে উপন্যাসটি বেস্টসেলার। কিন্তু আমেরিকার ডাকসাইটে প্রাতিষ্ঠানিক পত্রিকাগুলি সেটি মোটেই পাত্তা দেয়নি, রিভিউ ছাপতেও গররাজি। ‘আমার বইটা দশ লাখ কপির বেশি বিক্রি হয়েছিল, ওরা তাতে খুব দুঃখ পেয়েছিল,’ বলতেন ভাইডাল। প্রতিষ্ঠান-বিরোধী সাহিত্য এবং বিকল্প যৌনতা...আজকের দুই চিন্তাস্রোতেরই পূর্বসূরি ছিলেন এই লেখক।
ইউজিন লুথার গোর ভাইডালের ধমনীতে অবশ্য পরস্পরবিরোধী অনেক স্রোত। ঠাকুর্দা টমাস গোর ওকলাহোমা প্রদেশের ডেমোক্র্যাট সেনেটর। বাবা বিমান-বাণিজ্যের ডিরেক্টর। মা ব্রডওয়ের অভিনেত্রী। ন’বছর বয়সে মা-বাবার বিবাহবিচ্ছেদ। ১৭ বছর বয়সে মার্কিন সেনাবাহিনিতে নাম লিখিয়ে এক জাহাজে চেপে আলাস্কা চলে গেলেন গোর। মহাযুদ্ধের অন্তিম পর্ব তখন, ১৯৪৫ সাল। ততদিনে গোরের মা হিউ অকিনক্লোজ নামে এক ফিনান্সিয়ারকে বিয়ে করেছেন। অকিনক্লোজ পরে গোরের মাকে ডিভোর্স করে অন্য এক ভদ্রমহিলাকে বিয়ে করবেন। জ্যাকলিন নামে তাঁদের এক কন্যাও হয়। গোর ভাইডাল শুধু লেখক নন, লতায়-পাতায় জ্যাকলিন কেনেডির দূর সম্পর্কের সৎ ভাই। এবং প্রাক্তন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোরের আত্মীয়।
তবু গোর লেখক হলেন। টেনেসি উইলিয়ামস, নরম্যান মেইলারের মতো লেখক, পল নিউম্যানের মতো অভিনেতা তখন তাঁর বন্ধু, সমকামী বন্ধু হাওয়ার্ড অস্টেনের সঙ্গে ইতালিতে দিন কাটান। প্যারিসে লেখক আঁদ্রে জিদ তাঁকে ‘যৌনতা-বিপ্লবের অগ্রদূত’ আখ্যা দিচ্ছেন। হলিউডে চিত্রনাট্য লিখতে এলেন। চার্লটন হেস্টনের ‘বেন হুর’ ছবির চিত্রনাট্য ঘষামাজাও করেছিলেন, কিন্তু পর্দায় নাম ছিল না। পরে জুলিয়ান, লিঙ্কন ইত্যাদি ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখে তিনি কাঁপিয়ে দেবেন।
ষাটের দশকে ডেমোক্র্যাটদের হয়ে নিউ ইয়র্কে প্রথম ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন গোর। ঠাণ্ডা যুদ্ধের সময় চিনাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি, প্রতিরক্ষায় বাজেট কমিয়ে শিক্ষাখাতে খরচ বাড়ানো ইত্যাদি অনেক দাবি তুলেছিলেন তিনি। এবং স্বাভাবিক ভাবেই ভোটে হেরে গিয়েছিলেন। হেরেছিলেন দ্বিতীয় বার, ’৮২ সালেও। গোর ভাইডাল আসলে ডেমোক্র্যাটদের মধ্যেও বামপন্থী। “আমেরিকায় একটাই দল। টাকা পয়সা সম্পত্তির দল। ওদের দু’টো ভাগ। রিপাবলিক আর ডেমোক্র্যাট। রিপাবলিকানরা বেশি বোকা, ডেমোক্র্যাটরা বেশি অসৎ,” লিখেছিলেন তিনি।
বন্ধু নরম্যান মেইলার এক বার হুইস্কির বোতল ভেঙে মারতে গিয়েছিলেন ওঁকে। তখন নারীবাদের স্বর্ণযুগ। অনেকেই নরম্যান মেইলারের লেখার বিরুদ্ধে। গোর ভাইডাল লিখলেন, ‘ঠিক কথা। নরম্যান মেইলার পর্নো লেখে।’ পরে ম্যানহাটনের এক ডিনার পার্টিতে নরম্যান মেইলার গোর ভাইডালকে পেটাতে আসেন। দুটো ঘুঁষি হজম করে গোর ভাইডাল বলেন, “জবাব দিতে পারছিস না, তাই মারপিট করছিস বুঝি?”
কথা হারাতে অবশ্য গোর ভাইডালকে দেখা যায়নি। ‘সিম্পসনস’ সিরিজে কণ্ঠদান ছিল। কয়েক বছর আগে লেখক বন্ধু ট্রুম্যান কাপোটে মারা গিয়েছেন। গোর ভাইডালের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলেন এক সম্পাদক। জবাব এল, “এই কেরিয়ার-মুভটা বুদ্ধিমানের মতো।”
নিজের সম্পর্কেও কি সে রকমই বলতেন? বছর কয়েক আগে এক সাক্ষাৎকারে শেষ ইচ্ছা জানিয়েছিলেন, ওয়াশিংটনের রকক্রিক সমাধিতে সমাহিত হওয়া। তাঁর বন্ধু ও ‘পার্টনার’ হাওয়ার্ড অস্টেন সেখানেই শেষ শয্যায় শায়িত যে! “ওই প্লটটায় আমাদের ভাগাভাগি করে একসঙ্গে থাকার কথা। হাওয়ার্ডের সঙ্গে দেখা করার জন্য তাই মুখিয়ে আছি,” বলেছিলেন গোর। |