নোবেল পুরস্কার কত বড়? অর্থমূল্যে? ১২ লক্ষ ডলার।
অর্থমূল্যে, হয়তো বা সম্মানেও তার চেয়ে বড় পুরস্কার পাচ্ছেন কলকাতার বিজ্ঞানী অশোক সেন। যিনি আপাতত গবেষণারত ইলাহাবাদের হরিশচন্দ্র রিসার্চ ইনস্টিটিউটে। অশোক পাচ্ছেন ৩০ লক্ষ ডলার (প্রায় সাড়ে ষোলো কোটি টাকা) মূল্যের ‘ইউরি মিলনার পুরস্কার’। আরও আট জন বিজ্ঞানীর সঙ্গে।
এ কোন পুরস্কার? নাম তো শোনা যায়নি আগে। ঠিক। যাবে কী করে, এ পুরস্কার যে শুরু হল এই ২০১২ সাল থেকেই। পুরস্কারদাতা ইউরি মিলনার। যিনি রুশ নাগরিক। পড়েছিলেন পদার্থবিদ্যা। তার পরে গবেষণায় না গিয়ে ঢুকেছিলেন শেয়ারবাজারে! এবং আপাতত কোটি-কোটি-কোটি ডলারের মালিক! বিনিয়োগ করেছেন ফেসবুক-এর মতো রমরমিয়ে চলা সংস্থায়।
কেন দিলেন পুরস্কার? মিলনারের ব্যাখ্যা: এই পুরস্কার তাত্ত্বিক গবেষণার জন্য। তা হোক না কেন পদার্থবিদ্যা বা অঙ্কের মতো বিষয়। |
কোন ধরনের তাত্ত্বিক গবেষণা? মিলনারের জবাব: যে সব কাজের জন্য নোবেল এখনই মিলছে না, অথচ গবেষণার ফলাফল রীতিমতো গুরুত্বপূর্ণ, সেই সব সাফল্যের জন্যই এই সব পুরস্কার।
আর মজাটা সেখানেই। অশোক পুরস্কার পাচ্ছেন আমেরিকায় গবেষণারত এডওয়ার্ড ইউটেন, জুয়ান মালদাসেনা, নিমা আরকানি-হামেদ-এর মতো বিজ্ঞানীদের সঙ্গে। বলাবাহুল্য, ওঁদের সঙ্গে অশোকেরও কাজ একই বিষয়ে।
বিষয়ের নাম ‘স্ট্রিং থিওরি’। সোজা কথায়, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে পদার্থবিদ্যার সব নিয়মের মূল নিয়ম খুঁজে পাওয়ার প্রয়াস। যে প্রয়াসে একদা মগ্ন থেকেও ব্যর্থ হয়েছিলেন স্বয়ং আলবার্ট আইনস্টাইন। অশোক, এডওয়ার্ড, জুয়ান এবং নিমা-র মতো পৃথিবী জুড়ে অনেক পদার্থবিজ্ঞানী চেষ্টা চালাচ্ছেন সেই আদি নিয়ম খুঁজতে। যে নিয়ম সত্য হলে এটা মানতে হবে যে, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যে কোনও পদার্থের ক্ষুদ্রতম উপাদান কোনও কণা নয়, সুতো (স্ট্রিং)-এর মতো কিছু একটা জিনিস।
এই তত্ত্বের পিছনে পদার্থবিজ্ঞানীদের দৌড় শুরু হয়েছে ১৯৮০-র দশক থেকে। দুঃখের বিষয়, তত্ত্ব তৈরির ব্যাপারে পৃথিবীজুড়ে শ’য়ে শ’য়ে বিজ্ঞানী ছুটলেও তত্ত্বের সমর্থনে পরীক্ষামূলক প্রমাণ কিন্তু এখনও মেলেনি।
এই যে মেলেনি, তা দেখে বিরক্ত এবং বীতশ্রদ্ধ ‘স্ট্রিং থিওরি’-র সমালোচকেরা। ওঁদের বক্তব্য, ওই থিওরি শুধু মস্তিষ্কের ব্যায়াম, গণিতের কচকচি ছাড়া আর কিছু নয়।
সমালোচকেরা এ কথা বললে কী হবে, ‘স্ট্রিং থিওরি’র গবেষকেরা কিন্তু ওই তত্ত্বের মহিমায় মুগ্ধ। কারণ, ওই তত্ত্ব সৌন্দর্যে ভরপুর। আর বিজ্ঞানীদের অধিকাংশের ধারণা, যা সুন্দর, তা সত্যও বটে। পরীক্ষায় প্রমাণ আজ না মিলছে তো কী, দূর ভবিষ্যতে পরীক্ষা প্রমাণ করে দেবে ‘স্ট্রিং থিওরি’ নিছক গণিতের কচকচি নয়।
বিতর্ক থাক। কলকাতার কাছে বড় খবর এটাই যে, এই শহরের এক সন্তান, স্কটিশ চার্চ কলেজে পদার্থবিদ্যার প্রয়াত অধ্যাপক অনিল কুমার সেনের ছেলে অশোক নোবেল পুরস্কারের চেয়েও ‘দামি’ পুরস্কারে ভূষিত। যে অশোক ক্লাসে ‘ফার্স্ট বয়’ ছিলেন না, অঙ্ক ভুল করায় বাবার কাছে ধমকও খেতেন ছোটবেলায়, সেই অশোক আজ পৃথিবীর প্রথম সারির পদার্থবিজ্ঞানীদের পাশে দাঁড়িয়ে! স্কটিশ চার্চ স্কুলের ছাত্র অশোক হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করার পর প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। সেখানে ওঁর সতীর্থ দীপঙ্কর হোম, পলাশবরণ পাল বা সুমিত রঞ্জন দাস প্রশংসায় ভরিয়ে দেন অশোকের কৃতিত্বকে। বর্ণনা করেন ওঁর ‘ট্র্যাক রেকর্ড’। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে কানপুর আইআইটি, সেখান থেকে আমেরিকার স্টোনিব্রুক। দেশে ফিরে মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ। তার পর থেকে ইলাহাবাদে। হাবভাব, চালচলনে অতিরিক্ত নিরুদ্বিগ্ন অশোক প্রায়শই আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠেন। ইনফোসিস ঘোষিত এক কোটি টাকার পুরস্কার নিতে তিনি হাজির হয়েছিল হাওয়াই চটি পায়ে!
অশোক এবং বাকি আট জনকে ইউরি মিলনার পুরস্কার অবশ্যই ফিরিয়ে আনবে সেই বিতর্ক সারল্য আর সৌন্দর্য কি সত্যের পূর্বশর্ত? যে থিওরি সবচেয়ে সুন্দর, তা কি সত্য হতে বাধ্য? এখন যদি বা না-ও হয়, ভবিষ্যতে কোনও দিন কি ‘স্ট্রিং থিওরি’র সত্যতা প্রমাণিত হবে? মিলনার প্রভাবিত হয়েছেন ‘স্ট্রিং থিওরি’র এই দিকটি নিয়ে। পুরস্কার দিয়ে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, শুধু পরীক্ষার সমর্থনের দিকে তাকিয়ে থাকলে গবেষণা এগোয় না। গবেষণা এগোয় চিন্তা দিয়ে। আর সেই চিন্তার অকল্পনীয় শক্তি প্রদর্শন করেছেন অশোক, এডওয়ার্ড, জুয়ান এবং নিমা। এঁরা যদি অদূর ভবিষ্যতে নোবেল পুরস্কার না-ও পান, অর্থাৎ পরীক্ষায় এঁদের গবেষণার সমর্থন না-ও মেলে, তবু এঁদের কৃতিত্ব পূজনীয়। মিলনারের এই যুক্তি প্রমাণিত হয় পুরস্কার তালিকায় আরও এক জনের নাম থেকে। তিনি আন্দ্রেই লিন্দে। গবেষণা করেন আমেরিকার স্টানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওঁর গবেষণার বিষয় ‘ইনফ্লেশন’। নাঃ, অবশ্যই অর্থনীতির মুদ্রাস্ফীতি নয়, এ হল ব্রহ্মাণ্ডের ভয়ঙ্কর স্ফীতি। লাফিয়ে লাফিয়ে বড় হওয়া। যা ঘটেছিল ‘বিগ ব্যাং’ বা মহাবিস্ফোরণের ১৩৭০ কোটি বছর আগে। এই ব্রহ্মাণ্ডের জন্মের অব্যবহিত পরেই। যদিও ‘ইনফ্লেশন’-এর সপক্ষে পরীক্ষার ফল কিছুটা ইতিবাচক, তবুও তা এখনও চূড়ান্ত নয়। মিলনার প্রাইজ দিলেন লিন্দেকেও। হয়তো এ কথা ভেবে যে, তাঁর তত্ত্ব বুদ্ধির চূড়ান্ত নিদর্শন।
ইলাহাবাদে ফোন করে অশোককে ধরা গেল না। মোবাইলের সুইচ বন্ধ। অশোকের ছোট ভাই শ্রীরামপুর কলেজে অর্থনীতির অধ্যাপক অরূপ সেন বললেন, “সেটা শুধু এখন নয়। দাদার মোবাইল প্রায় সব সময়েই বন্ধ থাকে। জানেন তো, খবরটা কিন্তু ও আমাদের জানায়নি। আমরা শুনেছি বউদির কাছে!”
অর্ধেক দেশ যখন অন্ধকারে ডুবে, তখন গোটা দেশের কাছে আলোর রেখা কলকাতার অশোকের এই পুরস্কার। |