এক সময় তাঁদের কারও হাতে থাকত একে-৪৭, কারও হাতে থ্রি-নট-থ্রি। জঙ্গল-জীবনে শুধুই ছিল পুলিশ-যৌথ বাহিনীর তাড়া খেয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছোটাছুটি। আজ তাঁদেরই কারও হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং, কারও হাতে উলের পোশাক বোনার যন্ত্র।
এ ভাবেই জীবনের মূলস্রোতে ফেরার দিকে এক ধাপ এগোলেন প্রাক্তন মাওবাদী রাজারাম সোরেন, করণ কৈবর্ত, জাগরী বাস্কে, আকরি সহিস-সহ আরও অনেকে। আত্মসমর্পণ করার পরে এত দিন তাঁদের ঠিকানা ছিল পুরুলিয়া জেলা পুলিশের ‘ট্রানজিট ক্যাম্প’। মাওবাদীদের ‘শহিদ সপ্তাহ’ চলাকালীনই অযোধ্যা স্কোয়াডের এই আত্মসমর্পণকারী সদস্য, সদস্যাদের স্বনির্ভর করে তোলার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করল পুরুলিয়া জেলা প্রশাসন। সোমবার থেকে পুরুষদের গাড়ি চালানো ও মহিলাদের উল বোনার প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়েছে।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, রাজারাম সোরেন ওরফে সাগেন সাঁওতাল, লম্বোদর মাঝি ওরফে ইভন, দুর্যোধন রাজোয়াড় ওরফে সুজন, করণ কৈবর্ত ওরফে বিকল্প, ভজহরি মাহাতো ওরফে ভরত, রমেশ সিংহ সর্দার ওরফে তপন, রবি মান্ডি ওরফে সিংরাই, জাগরী বাস্কে, শিবানী সিংহ সর্দার এবং আকরি সহিসমাওবাদীদের অযোধ্যা স্কোয়াডের এই ১০ জন সদস্য-সদস্যা রাজ্য সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আত্মসমর্পণ করেছেন। কেউ পুরুলিয়া জেলা পুলিশের কাছে, কেউ ঝাড়গ্রামে জঙ্গলমহল উৎসবে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে, কেউ কেউ সরাসরি মহাকরণে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। প্রথম সাত জন পাচ্ছেন গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ। বাকি তিন মহিলা সদস্যকে উল বোনা শেখানো হচ্ছে। সোমবার থেকে এটাই তাঁদের রুটিন। রোজ যাতায়াত হবে ক্যাম্প থেকে প্রশিক্ষণ শিবিরে। |
জঙ্গল-জীবনকে পিছনে ফেলে এখন দ্রুত কাজ শিখে স্বনির্ভর হতে চান তাঁরা। বছর পাঁচেকের ছেলে বাহাদুরকে সঙ্গে নিয়েই প্রশিক্ষণ শিবিরে এ দিন এসেছিলেন রাজারাম। বললেন, “এক মাসের প্রশিক্ষণ। তার মধ্যেই ভাল করে শিখতে হবে।” রাজারামের স্ত্রী জাগরীর কথায়, “আজ প্রথম দিন। ভালই লাগছে।”
পুরুলিয়ার জেলাশাসক এবং পুলিশ সুপারকে নিয়ে মাওবাদীদের পুনর্বাসনের যে কমিটি হয়েছে, তারাই সম্প্রতি ‘ট্রানজিট ক্যাম্পে’ থাকা আত্মসমর্পণকারী মাওবাদীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিষয়টি ঠিক করে। জেলাশাসক অবনীন্দ্র সিংহ বলেন, “এঁদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে কী ভাবে সমাজের মূলস্রোতে ফেরানো যায়, তা নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। সেই মতো এক মাস ব্যাপী এই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয়েছে। প্রশিক্ষণ শেষে আমরাই কোনও ব্যাঙ্কের সঙ্গে কথা বলে ওঁদের জন্য ঋণের ব্যবস্থা করব, যাতে ওঁরা গাড়ি বা উল বোনার যন্ত্র কিনতে পারেন।” পুরুলিয়ার ডিএসপি (সদর) অংশুমান সাহা বলেন, “এই প্রশিক্ষণের আগে আমরা ওঁদের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। প্রশিক্ষণের কথা শুনে ওঁরা আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন।” প্রশিক্ষণ নেওয়ার ফাঁকে করণ কৈর্বত বলছিলেন, “সমাজের মূলস্রোতে ফিরতে চাই বলেই আত্মসমর্পণ করেছিলাম। এখন শুধু সামনে তাকাতে চাই।” একদা মাওবাদীদের অযোধ্যা স্কোয়াডের ‘সেকশন কমান্ডার’ দুর্যোধনের কথায়, “কাজ শিখে কাজেই ডুবে থাকতে চাই।” ফেলে আসা জীবনের কথা তুলতেই কিছুটা অস্বস্তি। রাজারাম ও করণ একযোগে বলেন, “ওসব কথা আর কেন! সব ভুলে যেতে চাই।” জাগরীরা কথা বলতে চাননি। আকরি শুধু বলেন, “কাজ শিখতে চাই।” |