|
|
|
|
প্রবন্ধ ২... |
সাম্রাজ্যবাদের মুণ্ডপাত না করে, আসুন, অর্থনীতি কী বলে দেখি |
খুচরো বিপণনে বিদেশি বিনিয়োগের বিরোধিতা করলেই শুনতে হয়, সেটা নাকি ক্ষুদ্র রাজনীতির সাধনা।
বিদেশি বিনিয়োগ এলে কার লাভ, কার ক্ষতি, সেই সমীক্ষা কিন্তু হয়নি। তা হলে, এই বিনিয়োগের
জন্য
এমন আকুল হওয়া কেন? অন্য স্বার্থ আছে কি? আলোচনা করছেন সুগত মারজিৎ |
খুচরো ব্যবসায়, যাকে রিটেল বলে, বিদেশি বিনিয়োগ এলে তাতে কার লাভ, কার ক্ষতি? দেশের সব রাজ্যের কি সমান লাভ? কেন্দ্রীয় সরকার এই বিনিয়োগকে ছাড়পত্র দিতে মরিয়া কেন? এই বিনিয়োগের পক্ষে যাঁরা সওয়াল করছেন, তাঁদের যুক্তি অর্থনীতির ধোপে টিকবে কি? অনেকগুলো প্রশ্ন দিয়েই শুরু করলাম। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা প্রয়োজন।
শাক-সবজি বা মাছ-মাংস যাঁরা উৎপন্ন করেন, তাঁরা হয় নিজেরাই বাজারে এই জিনিসগুলো বিক্রি করেন; অথবা অন্য ব্যবসায়ীদের বিক্রি করে দেন যাঁরা এই পণ্যগুলিকে খুচরো বাজারে বিক্রি করেন। বাজারে নতুন ব্যবসায়ী এলে তাঁদের উৎপাদিত পণ্যের দাম আরও বাড়বে। ফলে, চাষিদের তাঁরা গরিব বা বড়লোক, যা-ই হোন না কেন সুবিধা হওয়ার কথা। অন্য দিকে, বাজারে ব্যবসায়ীর সংখ্যা বাড়লে খুচরো দাম কমবে। খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগকে ছাড়পত্র দেওয়ার পক্ষে এই যুক্তি সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। এই যুক্তিতে ফাঁকফোকর কোথায়, খুঁজে দেখা যাক। না, আমি সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের কথা বলব না! নিছক অর্থনীতির যুক্তির মধ্যেই আমার ঘোরাফেরা।
খুচরো ব্যবসার বাজারে বড় পুঁজি ঢুকলে এত দিন যাঁরা ছোট পুঁজি নিয়ে ব্যবসা করছিলেন, তাঁরা নিঃসন্দেহে বিপাকে পড়বেন। বাজারে প্রতিযোগিতা কঠোর হলে কম দক্ষ প্রতিযোগীরা বাজার ছেড়ে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হবেন। এ দিকে, অর্থনীতির গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, বাজারে এক বার প্রতিযোগীর সংখ্যা কমে গেলে নতুন প্রতিযোগীরা আগের চেয়ে ঢের বেশি দাম ধার্য করতে পারবেন। অর্থাৎ, দ্বিমুখী বিপদ ছোট ব্যবসায়ীরাও মারা পড়বেন, আবার ক্রেতারাও বাড়তি দাম দিতে বাধ্য হবেন। আর্থিক সংস্কারের নামে আমরা একচেটিয়া কারবারের ক্ষেত্র প্রশস্ত করছি কি না, সেটা ভেবে দেখার। বিশ্বের অনেক দেশের অভিজ্ঞতা বলছে, যেখানে বড় বড় বহুজাতিক খুচরো ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করছেন, সেখানে স্থানীয় খুচরো বাজার বলতে আর কিছু দেখা যায় না। আসলে, পাইকারি ব্যবসায় স্থানীয় প্রতিযোগীদের মূলধন অনেক বেশি হয়। সেখানে হয়তো খানিকটা সেয়ানে-সেয়ানে লড়াই হতে পারে। কিন্তু খুচরো ব্যবসায় মূলধনের আয়তন খুব ছোট হওয়াও সম্ভব। আর সেখানেই প্রতিযোগিতার সুফল পাওয়া শক্ত। প্রতিযোগিতার কারণে ছোট পুঁজির ব্যবসায়ীরা বহুল পরিমাণে বাজার থেকে বেরিয়ে গেলে একচেটিয়া শক্তি উৎসাহিত হবে। |
|
কাঁচা-বাজার। বিদেশি বিনিয়োগ এলে এঁদের লাভ হবে তো? |
তা হলে, কত জন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, বিতর্কটা এই প্রশ্নটির জবাবের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। যদি ভারত সরকার সেটা আঁক কষে বুঝিয়ে দিতে না পারে, তা হলে গণতান্ত্রিক মতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অনুমানকে অবজ্ঞা করা অনুচিত হবে। হাজার হোক, দীর্ঘ কাল ধরে অসংগঠিত ক্ষেত্রকে এতটা বাড়তে দেওয়া এবং সংগঠিত ব্যবসাকে নিয়মের বেড়াজালে মুড়ে, নিম্নবিত্ত মানুষদের শিল্প ও কারিগরী দক্ষতার ব্যবস্থা না করে যে সমস্যা আমরা তৈরি করেছি, হঠাৎ তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া যায় না।
যদি সব স্থানীয় ব্যবসায়ী এখন প্রভূত মুনাফা করতেন, তা হলে বিদেশি পুঁজি এলেও তাঁরা একেবারে মারা পড়তেন না। তাঁদের মুনাফার হার কমত, কিন্তু তাঁরা প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে পারতেন। কোন রাজ্যে কত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কী পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, সে সম্পর্কে কোনও প্রামাণ্য হোমওয়ার্ক না করে, কোনও গবেষণাপত্র প্রকাশ না করে সংস্কারের নামে অর্থনীতির কিছু বাছাই করা যুক্তি আওড়ালে তা সমীচীন হবে না।
খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগের পক্ষে আর একটা যুক্তি হল, এই বিনিয়োগ এলে পরিকাঠামোগত উন্নয়ন হবে, তাতে অপচয় কমবে, কৃষকেরও লাভ হবে। এই যুক্তিটি কতখানি গ্রহণযোগ্য? ধরা যাক, আলুর প্রচুর ফলন হল। ফলে, বাজারে দাম একেবারে পড়ে গেল। তাতে কৃষকের মারাত্মক লোকসান। হিমঘর না থাকলে সেই লোকসান মেনে নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। কিন্তু, বিদেশি বিনিয়োগের দৌলতে হিমঘর তৈরি হলে চাষিরা সেখানে আলু মজুত করতে পারবেন। কিন্তু, কেউ কি এই গ্যারান্টি দিতে পারবে যে হিমঘরের মালিকরা সত্যিই বাজারদরের চেয়ে বেশি দামে ওই আলু কিনে নেবেন? তেমন গ্যারান্টি দেওয়া সম্ভব নয়। বরং, আশঙ্কার কারণ আছে যে হিমঘরের মালিকরা এমন ব্যবস্থা করবেন যাতে চাষিরা বাজারদরেই আলু ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।
অর্থাৎ, সমস্যাটা হিমঘর থাকা না-থাকার নয়। প্রশ্ন হল, চাষিরা কতটা সংগঠিত ভাবে আলুর দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন? যদি বহুজাতিক বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে সংগঠিত কৃষক শ্রেণির একটা স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা না থাকে, তা হলে যে পরিস্থিতিটি কার্যত অনিবার্য, তা হল আমরা বাজার থেকে ১৫ টাকা কেজি দরে আলু কিনব, কিন্তু চাষিরা কেজিপ্রতি সেই আড়াই টাকার বেশি পাবেন না। গোটা দুনিয়ায়, এমনকী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও এই ঘটনাটিই ঘটে খুচরো বাজারে যে দরে কৃষিপণ্য বিক্রি হয়, কৃষক তার অতি সামান্য অংশই পান। কিন্তু, সে দেশে কৃষকের জন্য পাহাড়প্রমাণ ভর্তুকির ব্যবস্থা আছে। আমাদের দেশেও ভর্তুকি খাতে অনেক টাকা সরকার বাহাদুর খরচ করে বটে, কিন্তু সেখানে কার প্রাপ্য কে পায়, তা একটা আলাদা আখ্যান।
খুচরো বাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা জাঁকিয়ে বসলে তার প্রকৃত ফল কী হবে? কলকাতার খুচরো বাজারে স্থানীয় কিছু বড় পুঁজি প্রবেশ করেছে। তার ফল খুব খারাপ হয়েছে বলে কোনও প্রমাণ নেই। কিন্তু, মূল প্রশ্ন হল, কলকাতায় বিলাসবহুল শপিং মল হওয়ার ফলে পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষের কতখানি উন্নতি হয়েছে বা পশ্চিমবঙ্গের সামগ্রিক আয় বৃদ্ধিতে তা কতটা সাহায্য করেছে? সেটা বোঝা শক্ত কাজ। যদি দেশে নতুন বিনিয়োগ আসে তা হলে নিশ্চয়ই আরও কর্মসংস্থান হবে। বাজার থেকে ভাল গুণমানের খাবারদাবার নিশ্চয়ই পৌঁছে যাবে বড় বড় খুচরো বিপণিতে। এই দেশে আর্থিক ভাবে ওপর দিকে থাকা মানুষ আর পাড়ার বাজারে যাবেন না। সেই বাজারে লোকের অভাব হবে কি না, সেটা অন্য প্রশ্ন, তবে দ্রব্যের গুণগত মান কমতে বাধ্য। অর্থাৎ, বাজারভেদে শ্রেণি বিভাজন আরও প্রকট হবে। এই বিভাজন কাম্য নয় এই কথাটা তখন যতই বলার চেষ্টা করি না কেন, বাজারের প্রসার ও প্রচারের চোটে সেই আপত্তি খড়কুটোর মতো ভেসে যাবে। এক দিন তবু সত্যের মুখোমুখি হতেই হবে।
যাঁরা বিদেশি বিনিয়োগের জন্য ব্যাকুল হয়ে আছেন, তাকেই সংস্কারের পরাকাষ্ঠা জ্ঞান করছেন, তাঁদের জন্য কিছু পাকাপোক্ত গবেষণার আব্রু প্রয়োজন ছিল। খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগ এলে তাতে কী লাভ, সে বিষয়ে প্রামাণ্য অর্থনৈতিক গবেষণা। কোনও সরকারি দফতর বিভিন্ন রাজ্যে খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাব্য প্রভাব বিষয়ে গবেষণা করেছে বলে আমার জানা নেই। এমন একটা প্রচার চলছে, যাতে মনে হয় সবাই যদি অর্থনীতিটা ঠিকঠাক বুঝত, তা হলে কালকেই আমরা উদ্বাহু হয়ে নতুন দোকানে বাজার করতে ছুটতাম। কিন্তু অর্থনীতিকেই যদি হাতিয়ার করতে হয়, তা হলে আরও হিসেবনিকেশ করতে হবে। সংস্কার মানে তো শুধু এই দেশটার বিদেশ হয়ে যাওয়া নয়।
|
সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন স্যোশাল সায়েন্সেস, কলকাতা-র অধিকর্তা। মতামত ব্যক্তিগত। |
|
|
|
|
|