রাজধানী দিল্লি-সহ ভারতের ন’টি রাজ্যের প্রায় ৪০ কোটি মানুষ অন্ধকারে। লক্ষাধিক যাত্রী নিয়ে তিনশো ট্রেন মাঝপথে দাঁড়িয়ে। হাসপাতাল থেকে শুরু করে বিভিন্ন জরুরি পরিষেবা থমকে। রাষ্ট্রপতি ভবন, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন থেকে শুরু করে গোটা ভিভিআইপি এলাকা বিদ্যুৎহীন। রবিবার মাঝরাত থেকে এই বিরল বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের সাক্ষী থাকল উত্তর ভারত। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে প্রায় ১৫ ঘণ্টা লেগে যায়।
প্রায় ১০ বছর পরে উত্তর ভারতে এ ধরনের ঘটনা ঘটল। পুরো নর্দান পাওয়ার গ্রিড বিকল হয়ে পড়ায় জম্মু-কাশ্মীর থেকে শুরু করে হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, পঞ্জাব, হরিয়ানা, চণ্ডীগড়, রাজস্থান, দিল্লি ও উত্তরপ্রদেশ একসঙ্গে বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছে, আগরার কাছে কোথাও বিদ্যুৎ পরিবহণ গ্রিড বিকল হয়ে পড়াতেই গোটা উত্তর ভারতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। কয়েকটি রাজ্য গ্রিড থেকে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ টেনে নেওয়ার ফলেই এই ঘটনা বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। দিল্লির সরকার এ জন্য উত্তরপ্রদেশ, পঞ্জাব ও হরিয়ানার দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছে। কোথাও গ্রিড বিকল হলে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় ওই জায়গাটির পুরো গ্রিড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার কথা। যাতে বাকি এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ অক্ষুণ্ণ থাকে। কিন্তু যান্ত্রিক কারণে সেই স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাও কাজ করেনি। কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎমন্ত্রী সুশীল কুমার শিণ্ডে জানিয়েছেন, কেন এমন হল, তা দেখতে কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের প্রধান এ এস বক্সির নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ১৫ দিনের মধ্যে কমিটি রিপোর্ট দেবে। |
বিপর্যয়ের খতিয়ান |
• নর্দান গ্রিডে বিভ্রাট
• বিদ্যুৎহীন ন’টি রাজ্য
• বিদ্যুৎ ছিল না প্রায় ৯-১৫ ঘণ্টা
• এনটিপিসি-র ৮টি কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ
• ৩০০টি ট্রেনের চলাচলে দেরি
• কয়েকটি রাজ্য গ্রিড থেকে বেশি বিদ্যুৎ নেওয়ায় বিপর্যয় |
|
রতন টাটা-সহ দেশের প্রথম সারির শিল্পপতিরা এর আগেও বলেছেন, বিদ্যুতের ঘাটতি দেশের শিল্প এবং উন্নয়নের পথে বড় বাধা। আজ এই বিপর্যয়ের পরে শিল্পমহল ফের সেই অভিযোগ করছে। তাদের কথায়, এমনিতেই দিনের মধ্যে বিদ্যুতের সর্বাধিক চাহিদার সঙ্গে জোগানের ফারাক থাকছে প্রায় ১২ শতাংশ। বণিকসভা সিআইআই-এর ডিরেক্টর জেনারেল চন্দ্রজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন। একই দাবি জানান বণিকসভা ফিকি-র সেক্রেটারি জেনারেল রাজীব কুমারও।
দুঃস্বপ্নের শুরু রবিবার রাত আড়াইটেয়। একসঙ্গে উত্তর এবং উত্তর-পশ্চিম ভারতের ন’টি রাজ্য বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ায় রাজধানী, শতাব্দী, দুরন্ত এক্সপ্রেস থেকে শুরু করে শয়ে শয়ে দূরপাল্লার ট্রেন মাঝরাস্তায় আটকে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রেই মালগাড়ি থেকে ডিজেল ইঞ্জিন খুলে তা দিয়ে যাত্রীবাহী ট্রেনগুলি নিয়ে যাওয়া হয়। রেল লাইনের সিগন্যাল ব্যবস্থাও কাজ করেনি। সব মিলিয়ে প্রায় ১০০ কোটি রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে। সোমবার সকালে দিল্লিতে তিন ঘণ্টা মেট্রো চলাচলও বন্ধ ছিল। ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সপ্তাহের প্রথম কাজের দিন সকাল থেকেই যানজটে আটকে যায় রাজধানী। দিল্লি-সহ বিভিন্ন শহরে জল সরবরাহে সমস্যা দেখা দেয়। তবে দিল্লি বিমানবন্দরে পরিষেবা ব্যাহত হয়নি। বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের সঙ্গে সঙ্গেই জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু করে দেওয়া হয়।
নর্দান পাওয়ার গ্রিড (দেশে ৫টি পাওয়ার গ্রিড আছে) থেকে জনসংখ্যার ২৮%-এর কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছয়। তা বিকল হওয়ায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিতেও। এনটিপিসি জানিয়েছে, উত্তর ভারতের ৮টি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ হয়, যাদের মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৮ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। এই অবস্থায় ভরসা হয় ভুটানের জলবিদ্যুৎ। ইস্টার্ন এবং ওয়েস্টার্ন গ্রিড থেকে ৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়। বিদ্যুৎ নেওয়া হয় পশ্চিমবঙ্গ থেকেও। রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা সূত্রে খবর, জাতীয় গ্রিডের মাধ্যমে এ দিন গড়ে ৪৫০ মেগাওয়াট করে বিদ্যুৎ দেওয়া হয়েছে।
প্রথমেই জরুরি পরিষেবা এবং দিল্লির ভিভিআইপি এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ চালুর চেষ্টা শুরু হয়। কিন্তু তা করতে প্রায় আড়াই ঘণ্টা লেগে যায়। বিকল গ্রিড মেরামত করে দিল্লি ও উত্তর ভারতের অন্যত্র বিদ্যুৎ পরিষেবা চালু হতে দুপুর গড়িয়ে যায়। তার পরেও বহু জায়গায় লোডশেডিং হয়েছে। সরকারি সূত্রের বক্তব্য, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি পূর্ণ ক্ষমতায় উৎপাদন শুরু করা না পর্যন্ত পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হবে না। এই অবস্থায় আপাতত সরকারি অফিসে এসি ব্যবহার বন্ধ করেছে পঞ্জাব সরকার। বিদ্যুতের ব্যবহার কমাতে সকাল আটটা থেকে দুপুর দুটো পর্যন্ত সরকারি দফতর চালু রাখা হবে।
এর আগে এমন বিপর্যয় ঘটে ২০০২ সালে। ২০১০ সালে-ও খারাপ আবহাওয়ার ফলে নর্দান গ্রিডে সমস্যা দেখা গিয়েছিল। তাই প্রশ্ন উঠেছে, এই ধরনের গ্রিড বিপর্যয় ঠেকাতে ভারত কতটা তৈরি? বিদ্যুৎমন্ত্রী সুশীল কুমার শিন্ডের অবশ্য যুক্তি, চার বছর আগে আমেরিকায় যখন এমন বিপর্যয় হয়, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে চার দিন লেগেছিল। সেই তুলনায় দ্রুত পরিস্থিতি আয়ত্তে এসেছে। এমনকী দশ বছর আগের তুলনায় অনেক কম সময়ে পরিস্থিতি সামলানো গিয়েছে। তাঁর মতে, গ্রিড থেকে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ টানা এই বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। সাধারণত ৪৮.৫ থেকে ৫০.২ হার্ৎজ ফ্রিকোয়েন্সিতে নর্দান গ্রিডে বিদ্যুৎ পরিবহণ হয়। কিন্তু যে সময় গ্রিড বিকল হয়ে পড়ে, তখন তার থেকে কিছুটা বেশি, ৫০.৪৬ হার্ৎজ ফ্রিকোয়েন্সিতে বিদ্যুৎ পরিবাহিত হচ্ছিল। যদিও বিভিন্ন বিদ্যুৎ সংস্থার কর্তাদের মতে, সেটাই হয়তো একমাত্র কারণ নয়। |