অর্থসঙ্কটের ধাক্কা যে কত ভয়াবহ হতে পারে, সেটা ফের দেখিয়ে দিল অন্ধ্রপ্রদেশের নেল্লোরে রেল দুর্ঘটনা। আজ ভোর রাতে নেল্লোরের কাছে আগুন লেগে পুড়ে গেল দিল্লি-চেন্নাই তামিলনাড়ু এক্সপ্রেসের এস-১১ কামরা। প্রাণ হারালেন অন্তত ৩২ জন। যাঁদের মধ্যে ৬ জন মহিলা, ৩টি শিশু। আহত অন্তত ২৫ জন। কমপক্ষে ১৬ জনের খোঁজ নেই। এবং প্রতিবারের মতো এ বারেও প্রশ্ন উঠল, বিভিন্ন কমিটির এত সুপারিশ সত্ত্বেও রেলের সুরক্ষা ব্যবস্থার এমন বেহাল দশা কেন? যার জবাব খুঁজতে গিয়ে প্রাক্তন রেলমন্ত্রী থেকে রেল বোর্ডের প্রাক্তন কর্তা, সকলেই বলেন, সুরক্ষা জোরদার করার টাকা নেই। জনমোহিনী রাজনীতির কারণে সেই টাকা জোগাড়ের জন্য যে রেলের ভাড়া বাড়াবেন, সে ইচ্ছেও নেই রেলমন্ত্রীর।
কী হয়েছিল আজ ভোরে? সওয়া চারটে নাগাদ নেল্লোরের কাছে এক ‘গেটম্যান’ দেখেন, তামিলনাড়ু এক্সপ্রেসের একটি কামরা দাউদাউ করে জ্বলছে। ট্রেনটি তখন ছুটছে প্রায় ১১০ কিলোমিটার বেগে। আতঙ্কিত রেলকর্মী খবর দেন স্টেশনে। সেখান থেকে ওয়াকিটকিতে খবর যায় চালকের কাছে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ট্রেন থামান। আধ ঘণ্টার মধ্যে আসে দমকল। কিন্তু তত ক্ষণে পুড়ে খাক কামরাটি।
দুর্ঘটনার পরে রেলের সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ফের প্রশ্ন উঠেছে। প্রাক্তন রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী জানিয়েছেন, রেলের অবস্থা খুবই অগোছালো। এবং তা বহু দিন ধরেই। তাঁর বক্তব্য, এই মুহূর্তে সুরক্ষা ক্ষেত্রে সবথেকে বেশি জোর দেওয়া দরকার। বস্তুত, এ বছর রেল বাজেটে যাত্রিভাড়া বাড়িয়ে সুরক্ষা ব্যবস্থার জন্যই টাকা তুলতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু জনমোহিনী রাজনীতির ধাক্কায় শেষ পর্যন্ত সরতে হয় দীনেশকে।
দায়িত্ব নিয়েই মুকুল রায় দীনেশের বাড়ানো যাত্রিভাড়ার অধিকাংশ ফিরিয়ে নেন। এখন দীনেশ বলছেন, যে সাধারণ মানুষের কথা বলে যাত্রিভাড়া বাড়তে দেওয়া হয় না, সুরক্ষার গলদের শিকার সাধারণত তাঁরাই। তাঁর কথায়, “শতাব্দী-রাজধানীর দেখভাল হয়। আর গরিবদের বেলায় আমরা ক্ষতিপূরণ দিয়ে দায় সারি!” প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাঁর আবেদন, “আপনি গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি দেখুন। কারণ, পরিস্থিতি খুব উদ্বেগজনক।”
কিন্তু জোটের বাধ্যবাধকতায় প্রধানমন্ত্রী রেল মন্ত্রকের কাজে কতটা নজরদারি করতে পারবেন, সে প্রশ্ন থাকছেই। এ দিন প্রধানমন্ত্রী শুধু জানিয়েছেন, রেল মন্ত্রককে সব রকম সাহায্য করা হবে। |
সিপিএম পলিটব্যুরোও দীনেশের মতোই রেল মন্ত্রকের কাজে প্রধানমন্ত্রীকে নজরদারি করার অনুরোধ করেছে। তারাও জোর দিয়েছে রেলের সুরক্ষার প্রশ্নে। রাজ্য কংগ্রেসের সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেছেন, “দীনেশবাবু সামান্য রেল ভাড়া বৃদ্ধির সুপারিশ করেছিলেন। কারণ, তিনি যাত্রী সুরক্ষায় উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে তুললে চেয়েছিলেন। তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হল।” আর বহরমপুরের সাংসদ অধীর চৌধুরীর কটাক্ষ, “রেলমন্ত্রীর তো সুরক্ষার দিকে নজর নেই। তিনি দিদির পিছনে ফাইফরমাস খাটার জন্য ঘুরছেন!”
সুরক্ষা নিয়ে সব মহলের প্রশ্নের মুখে কী বলছেন রেলমন্ত্রী? সুরক্ষার দিকটি যে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ, সে কথা মেনে নিয়েছেন তিনি। বলেছেন, “রেলের যা আর্থিক হাল তাতে সুরক্ষার জন্য আগেও প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিশেষ তহবিল চেয়েছিলাম। আবারও চাইব।” তবে সুরক্ষায় গলদের অভিযোগ নিয়ে সরাসরি কিছু বলেননি তিনি। বরং বলেছেন, “অন্তর্ঘাতের সম্ভাবনাকেও বাদ দিচ্ছি না।”
রেলমন্ত্রী থাকাকালীন সুরক্ষা ব্যবস্থা খতিয়ে দেখতে অনিল কাকোদকরের নেতৃত্বে সুরক্ষা কমিটি গড়েছিলেন দীনেশ। আগুন লাগলে কী করা উচিত, সে ব্যাপারে কমিটির সুপারিশ ছিল: প্রথমত, ট্রেনে ধোঁয়া ও আগুন লাগলে সঙ্গে সঙ্গে তা চিহ্নিত করতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার। দ্বিতীয়ত, কামরায় সাইরেনের ব্যবস্থা। যাতে যাত্রীরা আগুন বা ধোঁয়া দেখলে চালক ও অন্য যাত্রীদের সতর্ক করে দিতে পারেন। তৃতীয়ত, চলন্ত ট্রেনের প্যান্ট্রি কামরায় গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করে রান্না বন্ধ করা। সর্বোপরি, প্রতিটি কামরায় যথেষ্ট সংখ্যায় অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র রাখা। সুরক্ষা ব্যবস্থার জন্য তিনি এক লক্ষ কোটি টাকা ব্যয়বরাদ্দেরও সুপারিশ করেন।
কিন্তু সুপারিশ মানা হয় কোথায়? রেলকর্তাদের একাংশেরও অভিযোগ, দুর্ঘটনার পরে কমিটিগুলি নিয়মমাফিক রিপোর্ট দিয়ে গেলেও তা খতিয়ে দেখে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। কাকোদকর বা স্যাম পিত্রোদা কমিটি তাদের রিপোর্টে যাত্রী সুরক্ষা ও রেলের নিরাপত্তা বাড়াতে যা যা সুপারিশ করেছিল, তার ১০ শতাংশও করা হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন রেল-কর্তাদেরই একাংশ।
এখানেই উঠছে টাকার প্রশ্ন। রেল বোর্ডের প্রাক্তন কর্তা সুভাষ ঠাকুর বলেছেন, “সুপারিশ মেনে কাজ করলে যে টাকা দরকার, সেটা কোথায়? তাই যেমন আয়, তেমনই ব্যয় হবে।” তবে তিনি মানেন সুরক্ষার উপরেই সব থেকে বেশি জোর দেওয়া উচিত। কিন্তু তাতেও কি নুন আনতে পান্তা ফুরোবে না?
|