একটি উড়ন্ত চাকতি। তার পেটের ভিতর থেকে নেমে আসছে মাকড়সার মতো দেখতে ছয় চাকাওয়ালা এক গাড়ি। সেটি মাটিতে ছোঁয়ার পরেই চাকতিটি উড়ে গেল মহাকাশে। প্রাণের সন্ধানে আগামী সোমবার এ ভাবেই মঙ্গলের মাটি ছোঁবে নাসার ‘সর্বাধুনিক’ রোভার কিউরিওসিটি। আদতে যা মঙ্গলের এবড়োখেবড়ো মাটিতে ঘুরে বেড়ানোর জন্য একটা বিচিত্রদর্শন গাড়ি। আরও ঠিকঠাক ভাবে বললে একটা চলন্ত গবেষণাগার।
সেটাকে মঙ্গলের মাটিতে নামানোটাই দুরন্ত কঠিন একটা লড়াই। এর আগেও স্পিরিট ও অপরচুনিটি নামে দু’টি গাড়িকে (রোভার) মঙ্গলে নামিয়েছিল মার্কিন মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র নাসা। কিন্তু কিউরিওসিটি সেগুলির চেয়ে অন্তত দশ গুণ ভারী। পৃথিবীর চেয়ে ১০০ ভাগ হালকা বাতাস ফুঁড়ে এত বড় একটা রোভার অক্ষত নামানো এবং ধুলোর ঝড় থেকে সেটিকে বাঁচানোটাই সব চেয়ে কঠিন কাজ। এর জন্য তাই আটঘাটও বাঁধতে হয়েছে সে ভাবেই। লড়াইটা মাত্র সাত মিনিটের। তবু এর জন্যই রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করে আছে নাসা।
এই মুহূর্তটায় পৌঁছনোর জন্য প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল ছ’ বছর আগে। আর কিউরিওসিটি নামের গাড়িটিকে নিয়ে মার্কিন মহাকাশযান অ্যাটলাস-ভি ৫৪১ কেপ কার্নিভাল এয়ার ফোর্স স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু করে ৮ মাস আগে। ২০১১-র ২৬ নভেম্বর। কিন্তু তির ছুড়লেই তো হল না। ঠিক নিশানায় সেটিকে পৌঁছে দিতে মঙ্গলমুখী মহাকাশযানটির গতি ও অভিমুখে সামান্য অদলবদল করার প্রয়োজন ছিল। বলা যায় ‘ফাইন টিউনিং’। শনিবার সেই
কাজটা সাফল্যের সঙ্গেই সেরে ফেলেছে নাসা। এ বার অপেক্ষা (নাসার ভাষায়) ‘আতঙ্কের ৭ মিনিট’-এর জন্য।
আতঙ্কের কেন? কারণ, মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে ঢোকার সময় তাপ সামলানো, গতি কমানো ও ধুলোর ঝড় এড়িয়ে আলতো ভাবে রোভারকে নামিয়ে দেওয়া এই তিনটি কাজের কোনও একটিতে কম্পিউটারের সামান্য ভুলচুকেই পণ্ড হবে সব। |
মঙ্গলের আবহাওয়ায় রোভারবাহী উড়ন্ত চাকতিটি ঢুকবে প্রচণ্ড গতিতে, ৬ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ডে। তৈরি হবে প্রচণ্ড তাপ। ১৬ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস। চাকতির সামনের দিকে তাপরোধী ঢালটা তখন খুদে সূযের্র মতো জ্বলছে। তাকে ঠান্ডা করতে কমাতে হবে গতি। আগের দু’টি রোভারের ক্ষেত্রে এ কাজে যে রকম প্যারাস্যুটে কাজ হয়েছে, এ বার তাতে হবে না। কারণ এ বারের রোভার অনেক বেশি ভারী। এ বার তাই পাঠানো হয়েছে পেল্লায় মাপের প্যারাস্যুট। এত বড় প্যারাসুট এর আগে কখনও তৈরি করেনি নাসা। মাটি থেকে ১১ কিলোমিটার উঁচুতে খুলে যাবে সেটি। তাতে গতি কিছুটা কমবে ঠিকই তবে পুরো কাজটা হবে না। আরও তিন কিলোমিটার নেমে খুলে যাবে তাপরোধী ঢাল। খুলে দেবে কিউরিওসিটির নীচের দিকে লাগানো চোখ (পড়ুন রেডার)। দ্রুত নামতে নামতেই তখন সে নীচের জমি যাচাই করছে। নামার জন্য সব চেয়ে জুতসই জায়গাটি বেছে নিতে। এখনও গতি এতই বেশি, যে এ ভাবে নামলে তো আছড়ে পড়বে রোভার!
এ বার তাই আলাদা ব্যবস্থা। ছোট ছোট ৮টি রকেট চাকতিকে উপরের দিকে ঠেলতে থাকবে। গতি কমবে এতেই। ফলে তখন আর প্যারাস্যুটের দরকার নেই। সেটি আলাদা হয়ে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে চাকতিটি সরিয়ে যাবে রকেটের ধাক্কায়। নয়তো প্যারাস্যুটে জড়িয়ে যেতে পারে তা।
এ বার শুরু সব চেয়ে অভিনব পর্যায়টি। রোভারবাহী চাকতি মাটিতে গিয়ে পড়লেই উঠবে ধুলোর ঝড়। কিউরিওসিটির চোখের বালি হয়ে উঠতে পারে তা। ধুলোয় নষ্ট হয়ে যেতে পারে রোভারটির যন্ত্রপাতি। তাই এ বারই প্রথম ব্যবহার হবে একটা ঝুলন্ত ক্রেন। তাতে ঝুলে নামতে থাকবে রোভার। মাটি থেকে ঠিক ২০ মিটার উপরে থমকে যাবে উড়ন্ত চাকতি। কেবল মুহূর্তখানেকের জন্য। ঝুলন্ত রোভার মাটি ছোঁয়া মাত্রই, পাশের দিকে সরে উপরে উঠে যাবে উড়ন্ত চাকতি, ধুলোর ঝড় এড়াতে।
মঙ্গলের মাটিতে এ বার যাত্রা শুরু কিউরিওসিটির!
দু’বছর ধরে মঙ্গল নিয়ে মানুষের কৌতূহল মেটাবে সে। খুঁজবে প্রাণের সম্ভাবনা। পরমাণু শক্তিচালিত এই গবেষণাগারে মাটি ও পাথরের নমুনা সংগ্রহের যাবতীয় সরঞ্জাম রয়েছে। নমুনাগুলি বিশ্লেষণও করবে এই মঙ্গলযান। বিশ্লেষণের পর সেই তথ্য সরাসরি পাঠাবে পৃথিবীতে।
ইন্ডিয়ান অ্যাস্ট্রোবায়োলজি রিসার্চ সেন্টার-এর গবেষক পুষ্কর গণেশ বৈদ্য জানালেন, মঙ্গলে জল রয়েছে কি না, তা জানার জন্যই এই অভিযান। জীবদেহের অন্যতম উপাদান হাইড্রোজেনের খোঁজ পেলে তা হবে যুগান্তকারী আবিষ্কার। এই অভিযান সফল হলে সেটা মানবসভ্যতাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে তিনি মনে করেন। পুষ্করের বিশ্বাস, “অত্যাধুনিক প্রযুক্তির জন্য সফল হবে কিউরিওসিটির অভিযান। ২০৩০-এ যে মঙ্গল অভিযানের কথা ভাবা হচ্ছে, তার ভিত্তি তৈরি হবে। মানবসভ্যতার ইতিহাসে নতুন দিক দেখাবে।” |