বেসরকারি এবং সরকারি হাসপাতালের উপর নজরদারি করিতে নির্দেশিকা জারি করিল রাজ্য সরকার। যে অসুখে যে ধরনের চিকিৎসা প্রক্রিয়া প্রত্যাশিত, সে ক্ষেত্রে সেই অনুসারে বিবিধ পরীক্ষা এবং ঔষধ প্রয়োগ করিতে হইবে। বেসরকারি চিকিৎসার ক্ষেত্রে অকারণে বহু পরীক্ষা করাইয়া এবং ঔষধ খাওয়াইয়া রোগীর খরচ বাড়াইয়া ও রোগ আরও জটিল করিয়া তোলার প্রবণতা বন্ধ করিতে হইবে। সরকারের এই উদ্দেশ্য অযৌক্তিক নহে। ইহা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ যে, এ রাজ্যে চিকিৎসকদের দুর্নীতি এবং যথেচ্ছাচার যে ব্যাপক এবং অনিয়ন্ত্রিত, সেই সত্যটি স্বীকার করা হইল। দুই-একজন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের কিনারা করিয়া চিকিৎসা ব্যবস্থার রোগ নিরাময় সম্ভব নহে, গোটা ব্যবস্থাটির উপরেই নজরদারি প্রয়োজন, এই নির্দেশিকা তাহার প্রমাণ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁহার সরকারকে ধন্যবাদ জানাইতে হয় যে, চিকিৎসক এবং ঔষধ নির্মাতা, এই দুই বৃহৎ এবং পেশিবহুল স্বার্থগোষ্ঠীর চাপকে অগ্রাহ্য করিয়া সাধারণ নাগরিকের অসুবিধার কথা চিন্তা করিয়া তাঁহারা এই নির্দেশিকা জারি করিয়াছেন। অবশ্যই ইহা কেবল একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত হইয়া থাকিয়া যাইতে পারে, কাগজে-কলমে সদিচ্ছার প্রকাশমাত্র হইতে পারে। পূর্বের অভিজ্ঞতা স্মরণ করিলে সেই আশঙ্কা হওয়া অমূলক নহে। তবু ডাক্তার চটাইতে মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী যে ভয় পান নাই, রোগীর সুচিকিৎসার অধিকারকে যে তাঁহারা গুরুত্ব দিয়াছেন, কেবল এই সৎসাহসের জন্যই তাঁহারা প্রশংসার যোগ্য।
কিন্তু আক্ষেপের বিষয়, এই ফরমানটি কার্যকর করিবার দায় পড়িল সেই মেডিক্যাল কাউন্সিলের উপর, ডাক্তারদের নিয়ন্ত্রণ করিতে যে সংস্থার ব্যর্থতা সর্বজনবিদিত। ফলে নির্দেশিকাটি যতই ভাল হউক, নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনাটি কার্যকর করা প্রায় অসম্ভব। রোগীর খরচ কমাইতে কাউন্সিলের সদস্যরা অথবা সরকারি আমলারা কেন চিকিৎসকদের চটাইবেন, তাহার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য কারণ খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না। বিদেশে নজরদারির কাজটি করিয়া থাকে স্বাস্থ্য বিমা সংস্থাগুলি। যে হেতু রোগীদের চিকিৎসার খরচ জুগাইতে হয় বিমা সংস্থাগুলিকে, এবং অত্যধিক প্রযুক্তিগত পরীক্ষা, অকারণ ঔষধ প্রয়োগ কিংবা দীর্ঘ হাসপাতাল বাস খরচ বাড়াইয়া তোলে, তাই বিমা কোম্পানিগুলি তাহাদের নিজেদের ক্ষতি কমাইবার স্বার্থেই চিকিৎসা পদ্ধতির উপর নজরদারি করিয়া থাকে। সংস্থানিযুক্ত অভিজ্ঞ চিকিৎসকরা তাহা করিয়া থাকেন। ফলে পেশাদারি দক্ষতার ভিত্তিতে চিকিৎসার নিয়মিত মূল্যায়ন হইয়া থাকে, ইহার মধ্যে পদাধিকার লইয়া মান-অভিমানের সম্ভাবনা থাকে না। দুর্ভাগ্যের বিষয়, এ রাজ্যে তথা এই দেশেই স্বাস্থ্য বিমা ব্যবস্থাটি সম্প্রসারিত হইতে পারিতেছে না। জনস্বাস্থ্য বিমা কিছু কিছু রাজ্যে ভাল চলিতেছে, কিন্তু এ রাজ্যে তাহার পরিধি বড় নহে। উপরন্তু রোগী কী পাইবে, কী পাইবে না, তাহা নির্ধারণ করিতে গিয়া বিমা সংস্থাগুলি রোগীর সহিত দরাদরি বেশি করিয়া থাকে, ডাক্তারদের উপর তাহাদের নিয়ন্ত্রণ অতি সামান্য। রোগীর সম্পূর্ণ চিকিৎসা বিমার আওতায় না আনিলে চিকিৎসায় অতিব্যয়-অপব্যয় কমাইবার তাগিদ আসিবে না বিমা সংস্থাগুলির। অতএব সরকার যদি বাস্তবিক রোগীর স্বার্থে চিকিৎসার ব্যয় কমাইবার জন্য সচেষ্ট হয়, তবে তাহার যথাযথ উপায় হইবে জনস্বাস্থ্য বিমা প্রকল্পকে আরও বিস্তৃত এবং ফলপ্রসূ করা, এবং বিমা সংস্থার মাধ্যমে চিকিৎসার মান নিশ্চিত করা। সরকারি নির্দেশিকা দিয়া খুব বেশি কাজ হইবে না। |