দাঙ্গা-কবলিত নিম্ন অসমে শান্তিরক্ষায় সেনা মোতায়েন করিতে অতিরিক্ত বিলম্ব হইয়াছিল কি না, তাহা লইয়া বিতর্ক শুরু হইয়াছে। অসমের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ তো এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণে টালবাহানার জন্য কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে সরাসরি দায়ীই করিয়াছেন। গোলমালের সূত্রপাত হইতেই রাজ্য সরকার সেনা মোতায়েন করিতে চাহিয়াছিল, কিন্তু প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের সবুজসংকেত মিলিতে পাঁচ দিন বিলম্ব হইয়া যায় ইহাকেই মুখ্যমন্ত্রী দাঙ্গায় ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি বৃদ্ধির কারণ রূপে শনাক্তও করিয়া ফেলিয়াছেন। অন্য দিকে সেনাবাহিনীর তরফে বাহিনী মোতায়েনে পদ্ধতিগত জটিলতা এবং রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশের জন্য বাধ্যতামূলক অপেক্ষার সমস্যাটি তুলিয়া ধরা হইয়াছে। এই চাপান-উতোর এবং দোষারোপের অন্তরালে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন চাপা পড়িয়া যাইতেছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দমনের দায়িত্ব কাহার, রাজ্য পুলিশের, না কি সেনাবাহিনীর?
দাঙ্গা একটি আইনশৃঙ্খলার সমস্যা এবং আইনশৃঙ্খলা পুরোপুরি রাজ্যের এক্তিয়ার। শান্তি রক্ষা কিংবা সাধারণ ভাবে আইনের শাসন বলবৎ রাখার দায়িত্ব সুষ্ঠু ভাবে পালন করার জন্যই রাজ্যের হাতে পুলিশ, জি আর পি, সশস্ত্র পুলিশ ইত্যাদি বাহিনী থাকে। উর্দি-পরিহিত এই বাহিনীর একাংশের দাঙ্গা দমনের বিশেষ প্রশিক্ষণও থাকে। সে জন্য আগ্নেয়াস্ত্র, বিশেষ ধরনের গাড়িও সংগ্রহ করিয়া রাখা হয়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিলে এই বাহিনীরই তাহা মোকাবিলা করার কথা। দুর্ভাগ্যবশত, বেশ কিছু কাল যাবৎ দেশের যে কোনও স্থানে আইনশৃঙ্খলার বড় রকমের সমস্যা দেখা দিলেই সেনা তলব করার অভ্যাস রাজনীতিক কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনকে পাইয়া বসিয়াছে। কথায়-কথায় সেনাবাহিনীকে ডাকিয়া তাহার হাতে শৃঙ্খলারক্ষার ভার সঁপিয়া দেওয়ার এই প্রবণতাটি এতটাই বাড়িয়া গিয়াছে যে, স্থানীয় অসামরিক প্রশাসন অর্থাৎ পুলিশ ও নিরাপত্তা রক্ষীরা আইনশৃঙ্খলার গুরুতর সমস্যা ঘটিলেই হাত গুটাইয়া বসিয়া থাকে (যেমন কোকরাঝাড়ে), অপেক্ষা করে কখন সেনা আসিয়া কার্ফু, রুট-মার্চ, দেখামাত্র গুলি করার আদেশ জারি করিবে। ইহা একটি বিপজ্জনক রাজনৈতিক-প্রশাসনিক প্রবণতা।
অন্য একটি আশঙ্কাও আছে। গভীরতর আশঙ্কা। সেনাবাহিনীর কাজ দেশের প্রতিরক্ষা। বহিঃশত্রুর আক্রমণ ও অনুপ্রবেশ হইতে দেশবাসীকে সুরক্ষিত রাখার পাশাপাশি সীমান্তে কঠোর নজরদারি, সন্ত্রাসবাদীদের পরিকল্পিত নাশকতা ও অন্তর্ঘাত বানচাল করা প্রভৃতি। সুনামি কিংবা আয়লা ঘুর্ণিঝড়ের মতো, ভূমিকম্প কিংবা মহাপ্লাবনের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে জনসাধারণের পরিত্রাণ, নিরাপদ স্থানে তাহাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা, এমনকী তাহাদের পুনর্বাসনের মতো জনসেবামূলক কাজে সেনাবাহিনীর নিয়োগ হয়তো আবশ্যক। এই সব ক্ষেত্রে বাহিনীর দৃষ্টান্তমূলক দক্ষতা ও আত্মত্যাগের বহু প্রমাণও আছে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষার কাজে সেনা মোতায়েন ঠিক নয়। সেনা কর্তৃপক্ষ নিজেও এ ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত। মধ্য ভারতের মাওবাদী সন্ত্রাসের মোকাবিলায় সেনা মোতায়েনের সম্ভাবনা সেনা-কর্তারাই খারিজ করিয়া দিয়াছেন। গুলিতে বা বিস্ফোরণে হতাহত পুলিশদের উদ্ধার করিতে হেলিকপ্টার ব্যবহারের অনুমতি ব্যতীত আর কোনও ব্যাপারে সেনাবাহিনী ‘অপারেশন গ্রিন হান্ট’-এ জড়াইতে চাহে নাই। ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানের বাহিনীর মতো নয়। রাজনৈতিক নেতৃত্বের নির্দেশ ছাড়া তাহারা ছাউনির বাহিরে পা রাখিতে অভ্যস্ত নয়। জনসাধারণের বিভিন্ন অংশের উপর দমনপীড়ন চালাইবার বাহিনী হিসাবে নিয়মিত তাহাদের ব্যবহার করা অসমীচীন। |