নেলসন ম্যান্ডেলা এবং মহাত্মা গাঁধী নিয়ে কথা বলতে বলতে রুদ খুলিট স্বচ্ছন্দে চলে এলেন বলিউডে। “আপনাদের অনেক সিনেমা দেখেছি। তবে একটাও নাম বলতে পারব না। আমার সবচেয়ে ভাল লাগে বলিউডের নাচগুলো। মন ছুঁয়ে যায়।”
এ বার সোফা থেকে উঠে হাতের মোবাইল থেকে পুরনো দুটো ছবি দেখাতে দেখাতে অসীম কৌতূহলি খুলিট জানতে চান, এগুলো কার? কী নাম এই ‘বলিউড স্টার’দের?
দেখা গেল, রাহুল বসু এবং নেহা ধুপিয়ার সঙ্গে তাঁর পুরনো ছবি এখনও রেখে দিয়েছেন ডাচ কিংবদন্তি। জানুয়ারিতে গ্যাংটক ঘুরে যাওয়ার সময় সেই ছবি তুলেছিলেন। পাশে বসা তাঁর মহিলা ম্যানেজার কর্নি গুডলকে উচ্ছ্বাসের সঙ্গে দেখাতে লাগলেন, “এই দেখো, এঁরা বলিউড স্টার। আমার সঙ্গে ছবি তুলেছিল।”
ভারত সম্পর্কে আপনার ধারণা কি তা হলে শুধু বলিউড? শনিবার সাতসকালে কলকাতা বিমানবন্দরে ভিআইপি লাউঞ্জে সাক্ষাৎকারের সময় প্রশ্ন শুনে ডাচ ফুটবল তারকার মন্তব্য, “মহাত্মা গাঁধীর নাম কে না জানে? ওঁকে জানি। জানি, ভারত মানেই রাস্তায় সব সময় ব্যস্ত লোক দৌড়চ্ছে। ভিড়। দারুণ আন্তরিক সব লোক। আর আমি জানি ভারতের এক নম্বর খেলা ক্রিকেট। তবে দু’নম্বর খেলা কী জানি না।” আগের ভারত-যাত্রার স্মৃতিচারণের সময় তিনি রীতিমতো রোমাঞ্চিত, “আগের বার দিল্লি হয়ে গ্যাংটক যাওয়ার কথা ছিল হেলিকপ্টারে। খারাপ আবহাওয়ায় কপ্টার চলল না। তার পরে চার ঘণ্টা গাড়িতে যাওয়া। যখন-তখন দুর্ঘটনা হতে পারে, ওই রাস্তা জীবনে ভুলব না।” অতঃপর নীল জিন্সের খুলিট সরল বালকের মতো, “সিকিমে বাড়িগুলো প্রায় ঝুলন্ত। লোকে কী ভাবে থাকে! ওই পাহাড়ি রাস্তায় নাকি লোকে দিনে দু’বার যাতায়াত করে। তবে হোটেলটা অসাধারণ। আর দিল্লি থেকে যেখানে নামি, সেই জায়গাটার খুব কাছে দার্জিলিং। যেখানকার চা দারুণ।” |
অষ্টাশিতে তাঁর ইউরো জয়ী সতীর্থ উইম কোভারমান্স যে ভারতের জাতীয় কোচ, জানতেন না। অবাক লাগল, শুনে খুব উচ্ছ্বাস দেখালেন না। বরং গলায় মজা, “রব বান ভারতের টিডি হয়েছে শুনেছি। কোথায় না কোথায় কোচিং করাতে গিয়েছে! অস্ট্রেলিয়াতেও ছিল শুনেছি।”
আমেরিকার লস অ্যাঞ্জিলেস গ্যালাক্সি, রাশিয়ার তেরেক গ্রোজনি ক্লাব পরপর ছাঁটাই করায় খুলিট এখন বেকার। আপনার নেদারল্যান্ডসের কোচ হওয়ার কথা ছিল, কী হল? খুলিট এক বার উঁকি মেরে টিভিতে অলিম্পিকের উদ্বোধনের ছবি দেখে বললেন, “এখন অন্য কিছু কাজ হাতে। পরের বার আমি নেদারল্যান্ডসের কোচ হতে পারি। এটা আমার স্বপ্ন। ক’দিন আগে লুই ফান গাল কোচ হয়েছে। পরের বার আমি হব। জানেন তো, এখানে আসার পথে লন্ডন এয়ারপোর্টে ফান গলের সঙ্গে দেখা। উনি অলিম্পিক উদ্বোধন দেখতে যাচ্ছিলেন।”
এসি মিলানের ভুবনজয়ী সেই দলের তারকার খুলিট-মার্কা চুল বহু দিনই উধাও। এখন আরও পাতলা হয়ে এসেছে সামনের চুল। স্পেনকে কি আপনি সর্বকালের সেরা টিম বলবেন? জানতে চাই এবং খুলিটের জবাব, “স্পেন দুর্দান্ত ফুটবল খেলেছে। এখন ওদের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে প্রশ্ন নেই। কিন্তু ও ভাবে স্পেনকে সর্বকালের সেরা বলা ঠিক না। ফুটবলে এক-এক সময় এক-এক টিম আধিপত্য দেখায়। পেলের ব্রাজিল, বেকেনবাউয়ারের জার্মানি, ক্রুয়েফের নেদারল্যান্ডস, মারাদোনার আর্জেন্তিনা, আমাদের ইউরোপ জয়ী টিম। বলতে পারেন, স্পেন অবশ্যই সর্বকালের অন্যতম সেরার দাবিদার।”
ইউরোপিয়ান ফুটবলে এখন প্রধান তর্ক এ বার ফিফার বিশ্বসেরার স্বীকৃতি কে পাবেন? মেসি না রোনাল্ডো, না স্পেনের কেউ? খুলিট নিজে দেখা গেল মনে করেন, সামগ্রিক ভাবে মেসিই এক নম্বর। গত বার তাঁর হাত থেকেই এই পুরস্কার নিয়েছেন মেসি। কিন্তু এ বছর খুলিটের ভোট যেন রোনাল্ডোর দিকেই। তাঁর স্পষ্ট স্বীকারোক্তি, “ইউরোয় রোনাল্ডো খুব ভাল খেলেছে। ভাগ্য খারাপ বলে আগে হেরে গেল। কিন্তু এ বার ওই ফিফার সেরা হতে পারে।”
চব্বিশ বছর আগে আপনি নিজে ইউরোপ-সেরা হওয়ার পরে নেলসন ম্যান্ডেলাকে ট্রফি উৎসর্গ করেছিলেন কী ভাবে? তখন তো ওঁকে কেউ চিনত না! শুনে খুলিট গলার লকেট স্পর্শ করলেন কেন জানি না, “আসলে নেদারল্যান্ডসে তখন উনি খুব জনপ্রিয় ছিলেন। রেগে মিউজিক হত ওঁর নামে। সবাই জানত। উনি আর ওঁর বন্ধুরা আমায় পরে বলেছিলেন, ‘তুমি ম্যান্ডেলার নাম করায় ভেবেছিলাম, পুরস্কার বাতিল করে দেওয়া হবে।’ উনি আপনাদের গাঁধীর মতো ব্যক্তিত্ব।”
একটা সময় জর্জ বেস্ট পর্যন্ত তাঁকে মারাদোনার থেকে ভাল ফুটবলার বলেছিলেন। মারাদোনা বনাম খুলিট নিয়ে তর্ক হত মেসি বনাম রোনাল্ডোর মতো। খুলিট নিজে অবশ্য মারাদোনা নিয়ে উচ্ছ্বাস থামান না। “আমি যাদের খেলা দেখেছি, তার মধ্যে মারাদোনাই সেরা।” সেরা কোচ? খুলিট প্রথমে নাম করেন কিংবদন্তি ডাচ কোচ রাইনাস মিশেলসের। দু’নম্বরে আরিগো সাক্কি। সঙ্গে সংযোজন, “এখনকার কোচদের মধ্যে রবের্তো দি মাতিওকে ভাল লাগে। ও আমার খুব ভাল বন্ধু। ভাল লাগছে, ও চেলসির কোচ থেকে গেল বলে।”
কোচ নিয়ে কথা বলতে বলতেই তাঁর নিজস্ব কোচিং-দুর্ভাগ্যের কথা উঠল। চেলসি, নিউ ক্যাসল ইউনাইটেড, লস অ্যাঞ্জেলিস গ্যালাক্সি, ফেনুর্ডকোথাও দু’এক বছরের বেশি টিকতে পারলেন না কেন? বেকহ্যামদের পুরোন কোচ খুলিটের ব্যাখ্যা, “আমার সমস্যা হল, কোচিং করাতে গেলে সব সময় মাইক্রোস্কোপের তলায় রাখা হয়। আমার টিম ভাল খেললেও লোকে সহজে খুশি হয় না। আমি দেখাতে পারি, আমার কোচিংয়ে টিম খারাপ খেলেনি।” একটু হতাশা বাসা বাঁধে গলায়।
মুখের হাসিটা আবার ফিরে এল ভারতীয় ফুটবল এখন ‘ডাচ-দর্শন’ অনুসরণ করছে শুনে। প্রথমে আই লিগের পরিকাঠামোর খোঁজ নিলেন খুঁটিয়ে। সঙ্গে ব্যাখ্যা করলেন, কেন ডাচ ফুটবলই বিশ্বসেরা। “শুনছি এখন ইংল্যান্ডও ডাচ-মডেল অনুসরণ করছে! ইউরো কাপে আমরা হেরেছি প্রথম ধাক্কা সামলাতে না পেরে। নেদারল্যান্ডস সব সময় ৪-৩-৩ খেলে। এ বার কোচ মারউইক মুখে ৪-৩-২-১ ছকের কথা বললেও ওটা ৪-৩-৩-ই।” তার পরে দু’হাত দিয়ে পিরামিড বানিয়ে দেখালেন, “ওই ছক আসলে পিরামিডই। ডাচ স্টাইলে গেলে ভারত এই ছকেই খেলবে।”
ঠিক এক মাস আগে খুলিটের তিন নম্বর স্ত্রী এস্তেল (জোহান ক্রুয়েফের ভাইঝি) তাঁর বিরুদ্ধে দ্বিচারিতার অভিযোগ এনে হঠাৎই তাঁকে ছেড়ে চলে যান এক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন কিক-বক্সারের সঙ্গে। আমস্টারডামের খবর, হতভম্ব খুলিট নাকি চরম হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। কলকাতায় যে খুলিটের প্রবেশ, তিনি কিন্তু আবার নিজস্ব মেজাজে। বলিউড, গাঁধী, দার্জিলিং চা, ম্যান্ডেলা, মেসি, রোনাল্ডো নিয়ে দার্শনিক-সমাজতাত্ত্বিক রুড খুলিট। |